আমরা কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসব বিষয়ে আখ্যান খুঁজে পাই। রাবণ-বধ করবেন শ্রীরামচন্দ্র। কিন্তু রাবণ যে দেবী অম্বিকাকে আগেই স্মরণ করে রেখেছেন। রাবণের স্তবে দেবী হৈমবতীর মন আর্দ্র হয়েছে, উচাটন হয়েছে৷ রাবণের স্তবে দেবী অভয়া অভয়দানও করেছেন।
“স্তবে তুষ্টা হয়ে মাতা দিল দরশন।
বসিলেন রথে কোলে করিয়া রাবণ।।”
যুদ্ধে এসে রঘুপতি দেখলেন, রাবণের রথে বসে আছেন স্বয়ং হৈমবতী। নিজের ধনুর্বাণ ফেলে দিলেন তিনি, তাঁকে মাতৃজ্ঞানে প্রণাম করলেন৷ ব্যাঘাত ঘটল রাবণ-বিনাশের। তাহলে কী হবে! বিমর্ষ হয়ে ভূতলে বসে পড়লেন। কী উপায়! বিধাতাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। বিধি বললেন, অকালবোধন করে দেবী চণ্ডীর আরাধনা করতে হবে। দেবরাজ ইন্দ্র বলছেন, দেরী না করে তাই হোক৷ রাবণ বধের সলতে পাকানো শুরু হল।
সেই শরতে ব্রহ্মা বোধন করলেন দেবী দুর্গাকে, ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ হল। দেবতাদের সঙ্গে রামচন্দ্র মহামায়ার পূজা শুরু করলেন।
নিশা প্রভাত হল। বিধির বিধান মেনে শ্রীরামচন্দ্র স্নানদান করে প্রস্তুত হলেন। বনের ফুলে-পল্লবে, ফল-মূলের নৈবেদ্যে সমুদ্রের তীরে পুজোয় বসলেন তিনি। চণ্ডী-গানও রচনা করলেন।
“পূজি দুর্গা রঘুপতি,
করিলেন স্তুতি-নতি,
বিরচিল চণ্ডী-পূজা গান।।”
চণ্ডীপাঠ করলেন নিজেই। দেবীর গীতনাট হল। বানর বাহিনী জয়ধ্বনি দিল। তারা প্রেমানন্দে দেবীর গুণ বর্ণনাত্বক গান গাইছে। এইভাবে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামল।
“সায়াহ্নকালেতে রাম করিলা বোধন।
আমন্ত্রণ অভয়ারে বিল্বাধিবাসন।।”
রামচন্দ্র নিজেই দেবীর মৃণ্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে নিয়েছেন। শাস্ত্র নির্ধারিত আচারে দেবীর অধিবাস সম্পন্ন করছেন। দেবী আরাধনার নবপত্রিকা রূপ রচিত হয়েছে। নবপত্রিকার এক একটি উদ্ভিদে এক এক মাতৃদেবীর অধিষ্ঠান। তাঁরা দেবী দুর্গারই রূপভেদ। তাদের সম্মিলিত রূপ এই নবপত্রিকা।
“আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।”
শাস্ত্রের পদ্ধতি ও নিয়ম মেনেই রামচন্দ্র সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন৷ ভক্ত হনুমান ত্রিভুবন ঘুরে সমস্ত উপচার সংগ্রহ করে এনে দিয়েছেন।
“এইরূপে উদ্যোগ করিলা দ্রব্য যত।
পদ্ধতি প্রমাণে আছে নিয়ম যেমত।”
কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখ আছে, বেদ-বিধিমতে শ্রীরামচন্দ্র সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপূজা, নবমীবিহিত পূজা সম্পন্ন করেছিলেন। সঙ্গে ছিল দেবীর মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্যগীতের আয়োজন।
“শুদ্ধসত্ত্বভাবে পূজা সাত্ত্বিকী আখ্যান।
গীত নাট চণ্ডীপাঠে দিবা-অবসান।।”
নানান বন্যফল এনে নৈবেদ্য সাজিয়েছে কপিবাহিনি। পূজায় যেসমস্ত ফুল বানরবাহিনি সংগ্রহ করে এনেছিল তার মধ্যে পাওয়া যায় অশোক কাঞ্চন, জবা, মল্লিকা, মালতী, ধবা, পলাশ, পাটলী, বকুল, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, কদম্ব, পারুল, রক্তোৎপল, শতদল, কুমুদ, পারিজাত, শেফালী, করবী, কনক-চম্পক, কোকনদ, অতসী, অপরাজিতা, চম্পক, নগেশ্বর, কাষ্ঠমল্লিকা, দোপটি, জাতি, যূথী, আচিঝাঁটি, দ্রোণপুষ্প, মাধবী, টগর, তুলসী, তিসি, ধাতকী, ভূঁইচাঁপা, কেতকী, পদ্ম, বক, কৃষ্ণকেলি, স্বর্ণ-যূথিকা, বান্ধুলী, আঁধুলী, কুরচি, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম।
ষোড়শোপচারে পরমানন্দে শঙ্করী পূজা করছেন শ্রীরামচন্দ্র। কিন্তু দেবীর দয়া, আর্দ্রতা কোথায়? দেবী কি বঞ্চনা করবেন তাঁকে! সীতাদেবী কি উদ্ধার হবে না?
“নয়নে বহিছে ধারা অসুখী অন্তর।
কাঁদেন করুণাময় প্রভু পরাৎপর।।”
কাতর হয়ে পড়েছেন তিনি, তখন বিভীষণ বললেন —
“তুষীতে চণ্ডীরে এই করহ বিধান।
অষ্টোত্তরশত নীলোৎপল কর দান।”
দেবী আরাধনায় লাগবে নীলপদ্মের যোগান! কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে?
হনুমান দায়িত্ব নিলেন নীলপদ্ম সংগ্রহ করার। বললেন
“স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ভ্রমিয়া ভূমণ্ডল।
এক দণ্ডে এনে দিব শত নীলোৎপল।।”
বিভীষণ জানাচ্ছেন দেবীদহে একমাত্র নীলপদ্ম ফোটে। শ্রীরামচন্দ্রকে প্রণাম হনুমান গেলেন সেখানেই৷ অষ্টোতরশত পদ্ম তুলে দ্রুত এলেন তিনি। গুনে গুনে প্রভুর হাতে দিলেন পঙ্কজ ফুল। শ্রীরাম দেবীকে পদ্ম প্রদান করার সঙ্কল্প করলেন। কিন্তু পরীক্ষা করবার জন্য দেবী আগেই একটি পদ্ম হরণ করে নিয়েছেন।
“করিলেন ছল, বুঝিতে সকল,
দেবী হরমনোহরা।
হরিলেন আর, এক পদ্ম তাঁর,
মহেশ্বরী পরাৎপরা।”
এক পদ্মে কমতি হচ্ছে! বিস্মিত শ্রীরামচন্দ্র। সঙ্কল্প তবে কি ভঙ্গ হবে? কী উপায়! পুনর্বার হনুমানকে বলছেন, দেবীদহে গিয়ে আর একটি পদ্ম নিয়ে এসো৷ হনুমান বলছেন —
“শুন হে গোঁসাই, আর পদ্ম নাই,
দেবীদহে বনমালি।
হেন লশ চিতে, তোমারে ছলিতে,
পঙ্কজ হরিলা কালী।।”
বিড়ম্বনা কাটাতে শ্রীরামচন্দ্র তখন দেবী কালিকার স্তুতি করছেন।
“বিপদে আমার, না হয় তোমার,
বিড়ম্বনা করা আর।
মম প্রতি দয়া, কর গো অভয়া,
ভবার্ণবে কর পার।”
দেবীর পদতলে কাতর হয়ে পড়ে আছেন রামচন্দ্র। দুঃখিত অন্তরে রাম কাঁদছেন। বলছেন, সমুদ্রের ভিতর ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করবেন তিনি। অবশেষে তাঁর মনে হল, লোকে তো তাঁকে ‘নীলকমলাক্ষ’ বলে, তাঁর দু’টি নয়ন। এরই একটি তিনি দেবীর কাছে নিবেদন করবেন।
“যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোৎপল।
সঙ্কল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল।।
এক চক্ষু দিব আমি দেবীর চরণে।
এত বলি কহে রাম অনুজ লক্ষ্মণে।।”
স্তবন করতে করতে কাঁদছেন শ্রীরাম। এরপর তিনি তূণ থেকে বাণ নিয়ে চক্ষু উপড়াতে যাবেন, এমন সময় দেবী দুর্গা তাঁর হাত ধরলেন।
“চক্ষু উপড়িতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।
হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।”
এবার রাবণ বধের জন্য দেবীর আদেশ এল। দেবী বলছেন, পরমা প্রকৃতি জানকীকে হরণ করবে, এ সাধ্য কি রাবণের আছে? আসলে রাক্ষস বিনাশ করাতে সমুদ্রের মাঝে সেতু বাঁধিয়ে সীতা হরণের ছল করে শ্রীরামচন্দ্রকে এখানে আনা হয়েছে। না হলে রাক্ষস বিনাশ হবে না, আসুরিক শক্তি বধও হবে না! দেবী বলছেন,
“অকালবোধনে পূজা, কৈলে তুমি দশভূজা,
বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য, আমারে করিতে ধন্য,
অবনীতে করিলা প্রকাশ।”
এই হল অকাল বোধনের কাহিনি। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা করে দশমীর দিন মহেশ্বরীকে বিসর্জন দিয়ে সংগ্রাম করতে চললেন রঘুপতি রাম। যুদ্ধে বিজয়ী হলেন এবং মাতৃশক্তিকে আসুরিক শক্তির কবল থেকে উদ্ধার করে, দানব শক্তির বিনাশ সাধন করলেন। সেই থেকে মর্ত্যে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলন হল৷ বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হয়ে উঠেছে এই দুর্গাপূজাই। তাই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে বাঙালি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার