যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় এখনও কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে বলে জানাল পুলিশ। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করে তারা। ওই হস্টেলেই গত বুধবার উপর থেকে পড়ে গিয়ে এক ছাত্রের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। পুনর্নির্মাণের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা দাশগুপ্ত। বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখনও কয়েকজন পড়ুয়ার ভূমিকা তদন্তকারীদের আতশকাচের তলায় রয়েছে। সোমবার ১০-১২ জন পড়ুয়াকে যাদবপুর থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন পড়ুয়া এবং হস্টেলের আবাসিকও ছিলেন। ডিসি জানিয়েছেন, সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে এখনও বেশ কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই ধোঁয়াশা দূর করাই এখন লক্ষ্য লালবাজারের। র্যাগিংয়ের কারণেই ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার আলিপুর আদালতে সরকারি আইনজীবী সৌরীন ঘোষাল বলেছিলেন, ‘‘একটা অত্যাচারের গল্প পাচ্ছি।’’ তবে ‘র্যাগিং’ শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেননি। ছাত্রমৃত্যুর পর থেকেই হস্টেলের নানা ‘ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা’র কথা তুলে ধরে সরব হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের একাংশ।
ওই ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই যাদবপুরের বেশ কয়েকজন পড়ুয়া হস্টেল ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। তাঁরা কেন হস্টেল ছাড়লেন, কোথায় গেলেন, এ নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে পুলিশ। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় ওই পড়ুয়াদের কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। অন্য দিকে, গত ৯ অগস্ট, বুধবার ঘটনার রাতে যাদবপুরের হস্টেলে পুলিশকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। বুধবার রাতে ফোন পেয়ে হস্টেলে গিয়েও পুলিশ ঢুকতে বাধা পেয়েছিল বলে অভিযোগ। এই অভিযোগে সোমবার আলাদা করে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ। ভিতর থেকে মেন গেট বন্ধ ছিল, এই মর্মে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
পকসো আইনে কি মামলা
যাদবপুরে ছাত্রের মৃত্যুতে পকসো আইনে মামলার দাবি জানিয়েছে রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশন। ছাত্রমৃত্যুর মামলায় কি ওই ধারা যুক্ত করবে কলকাতা পুলিশ? সোমবার এ প্রসঙ্গে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আইন অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের যে পড়ুয়ার মৃত্যু হয়েছে, তাঁর বয়স ১৮ বছর হয়নি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ৯ মাস ৯ দিন। তাই এই ঘটনায় পকসো আইনে মামলার দাবি জানিয়েছেন কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী।
কারা হস্টেল ছেড়েছেন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের মৃত্যুর পর অনেক পড়ুয়াই হস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ আবার চলে গিয়েছেন শহরের বাইরে। কোন কোন ছাত্র হস্টেল ছেড়ে শহরের বাইরে গিয়েছেন, কেনই বা তাঁরা হস্টেল ছেড়ে দিলেন— এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ। যাঁরা বুধবারের পর থেকে হস্টেল ছেড়েছেন, তাঁদের সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ছাত্রমৃত্যুর সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে তা-ও। র্যাগিংয়ের কারণেই ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পর অনেক পড়ুয়াই যাদবপুরের হস্টেলে থাকতে ভয় পাচ্ছেন বলে খবর। হতে পারে, সেই কারণেই কেউ কেউ বিতর্ক এড়াতে হস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তবে তাঁরা প্রত্যেকেই তদন্তকারীদের আতশকাচের নীচে রয়েছেন বলে দাবি পুলিশের।
পড়ুয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার তদন্তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন পড়ুয়ার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে চায় পুলিশ। সোমবার ১০-১২ পড়ুয়াকে যাদবপুর থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম বর্ষের কয়েকজন পড়ুয়া এবং হস্টেলের আবাসিক। অন্য দিকে, বাংলা বিভাগের এক পড়ুয়াকে ডেকে পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধান কমিটি। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে যান ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। কিছু জিনিস বুঝতে পেরেছি। কিছু জিনিসে ধোঁয়াশা রয়েছে। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখছি।’’ ডিসি আরও জানিয়েছেন, বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত তিন
গত বুধবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের এ-২ ব্লকের নীচে এক ছাত্রকে উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার ভোরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। র্যাগিংয়ের কারণে মৃত্যু বলে অভিযোগ করে ছাত্রের পরিবার। ছেলের মৃত্যুতে হস্টেলের আবাসিকদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগও দায়ের করেন ছাত্রের বাবা। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে কলকাতা পুলিশ। এই ঘটনায় শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ও হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। রবিবার সকালে গ্রেফতার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই পড়ুয়া দীপশেখর দত্ত এবং মনোতোষ ঘোষকে। তাঁরা সকলেই পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন। দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘিরে হইচই পড়ে গিয়েছে।
ছাত্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
সোমবার নদিয়ার বগুলার বাড়িতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত পড়ুয়ার। মাখা সন্দেশ, পান্তুয়া খেতে বড্ড ভালবাসতেন তিনি। তাঁর প্রিয় ফল ছিল আপেল। সেই প্রিয় মিষ্টি, ফল, গীতা আর সাদা কাপ়ড়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হল তাঁর। ছাত্রের পারলৌকিক কাজ করেন তাঁর বাবা। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় বেশ কয়েক বার জ্ঞান হারান ছাত্রের মা। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় ছেলের ছবি ছুঁয়ে দোষীদের শাস্তির প্রতিজ্ঞা নেন ছাত্রের বাবা। তিনি বলেন, ‘‘শাস্ত্রীয় মতে আজ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হল। তবে যে দিন ছেলের মৃত্যুতে জড়িতদের শাস্তির উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারব, সেই দিনই হবে আসল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান! ছেলের ছবি ছুঁয়ে এই শপথ নিলাম।’’