সিপাই ঘোড়সওয়ার

গড়ের মাঠে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ দেখতে গেলে দর্শকরা ভয় পেতেন মাউন্টেড পুলিশ’কে। ঘোড়ায় চড়া পুলিশ। সাধারণ ঘোড়া নয়, অতিকায় লম্বা। আকাশপানে মাথা তুলে ঘোড়সওয়ারের মুখদর্শন করতে যাওয়া মানে চন্দননগরে মা জগদ্ধাত্রীর উচ্চতা অনুমানের অক্ষমতা। পর্বতপ্রমাণ ঘোড়াগুলি রীতিমত তেজী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জটলা করে থাকা কয়েকশো মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে দারুণ দক্ষ। ইংরেজ আমল থেকে এই মাউন্টেড পুলিস ব্যবহার হয়েছে গড়ের মাঠে ‘স্বদেশী’দের মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ সামলাতে। ওই দশাসই ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের তলায় কেউ পড়লে, সে পিষে যাবে, হাত পা তো ভাঙবেই। মাউন্টেড পুলিশের সামনে পড়ে গেলে প্রাণ হাতে পালানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না, তখন সব বাঙাল-ঘটি একাকার।

সেই মাউন্টেড পুলিশ ছোটানো হচ্ছে অহিংস প্রতিবাদকারীদের মধ্যে দিয়ে, কানাডার ওটায়া’তে। জাস্টিন ট্রুডো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন যা যুদ্ধের সময়ে করা হয়। যে কয়েক হাজার লরিচালক সারি সারি লরি দিয়ে প্রধান মহাসড়ক অবরোধ করেছেন, তাঁদের সকলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত, ক্রেডিট কার্ড অচল, বীমা বাতিল। শীতের রাতে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে পথে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ নিরীহ নরনারীর কাছ থেকে তাদের শিশু ও পোষ্যদের আলাদা করে দেওয়া হবে ব’লে সরকার চোখ রাঙাচ্ছেন। সরকার ও তার দোসর মিডিয়া ক্রমাগত এই স্বাধীনতাপ্রার্থী নাগরিকদের ‘নাৎসি’ ও ‘বর্ণবিদ্বেষী’ ব’লে বিষোদগার করছেন। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার এই সম্মিলিত আর্ত দাবির প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে সারা বিশ্বের বহু স্থান থেকে যে সকল মানুষ অনুদান পাঠাচ্ছেন, তাঁরাও রক্ষা পাচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানের রক্তচক্ষু থেকে। কদর্য ভাষায় গাল শুনতে হচ্ছে তাঁদের ফোনে, মেইলে, ওয়াটসআ্যপে, সরকারি সংবাদমাধ্যমে। পেমেন্ট পোর্টাল হ্যাক করে সেই অনুদানকারীদের নাম ও ইমেল ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেটে।

প্রগতিশীল উদারবাদীদের কপটতা এখন প্রায় কিংবদন্তী। ‘জীবন ও জীবিকার জন্য যাঁরা আন্দোলন করছেন, কানাডার সরকার সবসময়ে তাঁদের সমর্থন করে’ … এই মহাবাক্যটি উদ্গার করেছিলেন প্রগতির পরাকাষ্ঠা জাস্টিন ট্রুডো ভারতে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে এক বছরের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে। সেই ট্রুডো এখন নিজেরই দেশের মানুষের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সপ্তাহ দুয়েক অবরোধের পরেই। ভারতের মিডিয়া ‘একেই বলে কর্মফল’ গোছের কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। কিন্তু আসল কথাটাই এড়িয়ে যাচ্ছেন।

স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এখন কানাডা। কানাডায় বহু শিখ নরনারী বসবাস করেন। তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খালিস্তানপন্থী। এতটাই যে ইদানীং কানাডার কয়েকটি গুরুদ্বারে নামাজ পাঠ করা হচ্ছে। এঁরা যথেষ্ট বিত্তশালী ও ঐক্যবদ্ধ। ভোটও দেন, টাকাও ঢালেন। ট্রুডোর ডেমোক্রোটিক পার্টিতে এঁরা মোটা অঙ্কের লগ্নি করেন। এঁদের মুখপাত্র হয়ে কথা বলতে তাই প্রধানমন্ত্রী বাধ্য। এবারে প্রশ্ন, রাজধানীর পথঘাট ও দেশের বাণিজ্য অচল করে দিয়ে এই যে মূলতঃ লরিচালকদের জনসভা, এঁদের মধ্যে তো অগণিত শিখ। তাঁদের হাত থেকে উৎকোচ নেওয়া প্রগতিশীল প্রধানমন্ত্রী সেই দাতা সর্দারদের প্রতি আজ এত নির্মম কেন?

কারণ, উপরওয়ালার হুকুম। ফার্মা ও বিগ-টেকের ভ্রুকুটি। সেই ক্ষমতার কাছে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠির অবদান কয়েক পয়সা খুচরোর মত। এই আন্দোলনকে সফল হতে দিলে গোটা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। সে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। বরং এমন দমন নীতি নাও যাতে ন্যুনতম নাগরিক অধিকার চাওয়ার দুঃসাহস আর কোনদিন কেউ করতে না পারে।

সবই গণতন্ত্রের স্বার্থে। আপনার আমার স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের কথা ভেবে, বিজ্ঞানের রূপকথা শুনিয়ে।

– জয়দীপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.