“সবাই সব স্তরে কম্প্রোমাইস করে ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে ফেলেছেন“। সরকারি সভায় জেলাশাসকের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ও আমলার বদলি প্রসঙ্গে শুক্রবার এই প্রতিবেদককে এ কথা জানালেন বরিষ্ঠ শিক্ষাবিদ তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ বাসব চৌধুরী।
বাসববাবু জানান, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্টাফ কলেজে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের ট্রেনিং হত। এর জন্য পয়সা আসত ইউ জি সি দিল্লী থেকে। আমি অনেকগুলো কোর্স-এর কোঅর্ডিনেটর ছিলাম। বহু বিখ্যাত মানুষকে বক্তৃতা করবার জন্য ডেকে আনতাম। একবার এনেছিলাম অর্কপ্রভ দেব কে। তখন তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। সকলেই আমাকে বলেছিলেন, ওনাকে ফোন না করতে। শোনা যেত উনি ফোনে গালাগালি দেন। আমি ফোন করেছিলাম। কথা বললেন। আমি পরিচয় দেওয়াতে ‘প্রফেসর চৌধুরী’ বলেই কথা বললেন। নির্দিষ্ট দিনে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। আমি ওনাকে ওনার বাড়ি থেকে সায়েন্স কলেজে নিয়ে আসি। আসার পথে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আইএএস মানে কি। আমি উত্তর দিই, ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। উনি বললেন, ভুল হল। ওটা ইন্ডিয়ান আসিনাইন সার্ভিস। শুনেছি, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওনাকে রাজ্যপালের সচিব হিসেবে বদলি করেছিলেন। আর বলেছিলেন, ইউ আর টু হনেস্ট ফর রাইটার্স!
বিধান রায়ের সময় কে কে হাজরার গল্প শুনেছি। মুখ্যমন্ত্রী একটু উষ্মা প্রকাশ করাতে পদত্যাগ করে চলে গেছিলেন। পরদিন মুখ্যমন্ত্রী ওনার বাড়িতে গিয়ে পদত্যাগ পত্র ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। আর বলেন, বাবার ওপর কি ছেলে এভাবে রাগ করে?
আইএএস ই বলুন আর যাই বলুন, আত্মমর্যাদা খুইয়ে কোনো চাকরি করা যায় না। তবে সকলে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ নন। কথা আছে, যারা তেল খায়, তারা তেল দেয়। মুখ্যমন্ত্রী চড় থাপ্পড় কানমলার কথা বলতে পারছেন কারণ তাঁকে কোনো অফিসার বলছেন না, দেখুন, আমি অপমানিত হতে আসি নি। আসলে সবাই সব স্তরে কম্প্রোমাইস করে ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে ফেলেছেন। বুরোক্রেটরা নিজেরা যদি কোনো সুবিধে না নেন, তবে তাঁদের সম্মান নিয়ে কাজ করতে অসুবিধে নেই। কিন্তু বেতন ব্যাঙ্কে, বাকি সব ফ্রি তে, আগে আগে পাইলট কার, দশটা স্যালুটের মোহে মেরুদন্ড বেঁকে যায়।“
কোনও মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে রাজ্যের ভাবমূর্তি কি মার খায়? প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বাসববাবুর বক্তব্য, “রাজ্যের ভাবমূর্তির বিষয়ে বলতে পারব না। এটুকু জানি, যিনি নিজেকে সম্মান করেন, তিনি অন্যকেও সম্মান করেন। আলেক্সান্ডার ও পুরু-র গল্পটা মনে করবেন। বিজিত পুরু কে বিজয়ী আলেক্সান্ডার প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি আমার কাছে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করো? পুরু বলেছিলেন, রাজার কাছে রাজার মতো। সবাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে অসামান্য সৌজন্য ও ভদ্রতা প্রত্যাশা করেন। উনি সেই সৌজন্য ও ভদ্রতা সহনাগরিক এবং অন্যদেরকে দেখাচ্ছেন কিনা, সেটা ওনার কাছাকাছি যাঁরা থাকেন, তাঁরা জানবেন। আমি সে বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।
মেধাবী বাঙালিরা আইএএস পরীক্ষায় বসায় অনীহার এটাও কি অন্যতম কারণ? আপনার কী ধারণা? বাসববাবু জানান, “বাঙালি আইএএস হবে কিনা। মনে রাখবেন, ওটা একটা চাকরি। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা মালিক। আর যাঁরা তাঁদের অধীন, তাঁরা চাকুরীজীবি। চাকরি থেকে অভিমুখ যদি ব্যবসার দিকে যায়, তবে বাঙালি সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখবে। আকবর বাদশার চাকর ও হরিপদ কেরানির বাড়ির কাজের লোক কোয়ালিটেটিভলি এক গোত্রের। সেই জন্য আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালি শিক্ষক হতে চাইতো। এখন হয়তো তাও চাইবে না। সব গুলিয়ে গেছে। সুদিন আসতে সময় লাগবে।”
“কী জেলা চালাচ্ছ তুমি (জেলাশাসক)? এত দিন জেলায় আছো। আমার ধারণাই বদলে গেল। আমার পার্টির লোক হলে আমি টেনে চারটে থাপ্পড় মারতাম।’ সোমবার পুরুলিয়ার প্রশাসনিক বৈঠকে জেলাশাসকের ওপরে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরেই বদলি হন জেলাশাসক। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর জেরেই এই প্রতিবেদককে প্রতিক্রিয়া দিলেন ১৪ বছর বিভিন্ন সময়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন বাসব চৌধুরী।