ত্যাগব্রত দিবস, ২৪ শে ডিসেম্বর।

ত্যাগব্রত দিবসঋষি অরবিন্দ বলেছেন, সমগ্ৰ ভারতের হৃদয়ভূমি বঙ্গদেশে, বাংলার হৃদয়স্পন্দন ধ্বনিত হয় হুগলী জেলায়। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসেও হুগলী জেলার আঁটপুরের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর এক অচিন্তনীয় ঘটনার ফলে আঁটপুর শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে উঠল। বাবুরাম মহারাজের (স্বামী প্রেমানন্দ) মায়ের নিমন্ত্রণে এই সময়েই আঁটপুরের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ, বাবুরাম, শরৎ, শশী, তারক, কালী, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর ও সারদা—শ্রীরামকৃষ্ণের এই লীলাপার্ষদগণ পদার্পণ করেছেন। ২৪ ডিসেম্বর রাত্রে ধুনি জ্বেলে এই ত্যাগী পার্ষদবৃন্দ ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ধ্যানের শেষে ঈশ্বর আলোচনার সময় নরেন্দ্রনাথ যীশুর ত্যাগ-তপস্যাপূত অপূর্ব জীবন কথা প্রাণস্পর্শী ভাষায় বলে গেলেন। সেই প্রাণপ্রদ বাগ্মিতার প্রভাবে গুরুভ্রাতারা ধুনির লেলিহান শিখাকে সাক্ষী রেখে শ্রীভগবানের পাদপদ্মে অটুট সংকল্প জানালেন—তাঁরা সংসার ত্যাগ করবেন। পরবর্তীকালে সঙ্ঘগঠনে আঁটপুরের অবদানের কথা স্মরণ করে স্বামী শিবানন্দ বলেছেন, “আঁটপুরেই আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সংকল্প দৃঢ় হলো, ঐ ভাব আরো পাকা হলো।” আজ সেই ত্যাগব্রত সংকল্প দিবস।

১৮৮৬ সালে আগষ্ট মাসে ঠাকুরের শরীর যায়। আর ওই বছরই বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় (১৩ ই পৌষ, ১২৯৩) নয়জন গুরুভাই হুগলীর আঁটপুর গ্রামে বাবুরাম ঘোষের (শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ, পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ভারতের অধ্যাত্মিক ও সামাজিক কল্যাণে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করলেন। অন্যদিনও তো করতে পারতেন। কারণ আঁটপুরে তার বেশ কয়েকদিন আগেই স্বামীজি পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ২৪ শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যাতেই অশ্বত্থ তলায় ধুনি জ্বেলে তাঁরা বসলেন গভীর ধ্যানে। স্বামীজি যীশুখ্রীস্টের কথাও সেদিন বললেন। এইভাবে দিনটি পালনের পর পরবর্তীকালে পুরীতে গিয়ে সেই বাবুরাম মহারাজই খ্রীস্টান পাদ্রীদের ধর্মপ্রচারের জনসমাগমকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং স্বধর্ম চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য ‘হরিবোল হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে উত্তাল করেছিলেন এবং উপস্থিত মানুষকে তাতে সামিল করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, আর তাতে সফলও হয়েছিলেন। তারমানে এমন কোনো দাগ বাবুরাম মহারাজের মধ্যে সেদিন পড়ে নি, যাতে সধর্ম প্রীতির বাইরে তিনি কিছু ভাবতে পারেন। যদিও এরপর স্বপ্নে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এসে তাঁর ভুল ভাঙ্গালেন, এমন ব্যাখ্যা আছে।

এখন কেক পেস্ট্রি, নেটিভেটি এবং ক্রিসমাস ট্রি-র আলোকমালায় বড়দিন পালন করতে হিন্দুরা যখন উদ্বেলিত, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, স্বামীজি কী বলেছেন ঘটা করে বড়দিন উৎসব পালনের কথা? এদিন কী আমাদের জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাইবেল পাঠ করে যীশুর জন্মদিন পালন করতে হবে?

ব্রিটিশ শাসনে থেকে স্বামীজি হয়তো খ্রিস্টীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের সেরা দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনার বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন তিনি। অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া। শিকাগোতে তিনি হিন্দুধর্মের প্রচারের জন্যেই গিয়েছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারীদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতবর্ষ কখনই অধ্যাত্মসম্পদে দরিদ্র নয়, দরিদ্র অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে। তাই ২০ শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালের শিকাগো ভাষণে বলছেন, “তোমরা খ্রিস্টানেরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের কাছে ধর্মপ্রচারক পাঠাতে খুবই উৎসাহী; কিন্তু বল দেখি অনাহার ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেহগুলো বাঁচানোর জন্য কোনো চেষ্টা কর না কেন? ভারতবর্ষে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার মানুষ খিদেয় মৃত্যুমুখে পড়ে, কিন্তু তোমরা খ্রিস্টানেরা কিছুই করনি। তারা ভাত চাইছে আর আমরা তাদের পাথরের টুকরো তুলে দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হল তাকে অপমান করা।”

মনে রাখতে হবে স্বামীজি অন্য ধর্ম থেকে ভাব নেবার ব্যাপারে খুবই selective ছিলেন। যীশুর সামাজিক সাম্যনীতি তাঁর প্রাণ স্পর্শ করে থাকবে; জগতের কল্যাণের জন্য যে ত্যাগ দরকার হয়, তার রসদও যীশুখ্রীস্টের মধ্যে তিনি পেয়ে থাকবেন। এখন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার পর মানুষ স্বভাবতই তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, নতুবা নানান মত ও পথে তা অতিক্রমণ করতে মনস্থ হয়, কখনও কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির মান্য ধর্মকে তীব্রভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা জন্মায়। ব্রিটিশ শাসনে থেকে স্বামীজিও হয়তো সেই ধর্মীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের ধর্মীয় সেরা দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন। এখানে তাঁর পথপ্রদর্শক গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনিই তো ১ লা জানুয়ারি, আর এক খ্রীস্টিয় দিনে ‘কল্পতরু’ হয়ে পথ দেখালেন তাঁকে।

দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৯২ সালের ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বরের; স্থান কন্যাকুমারী। আবারও ২৫ ডিসেম্বরকে ব্যবহার করলেন স্বামীজি। তিনি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ডাইনে-বামে-পশ্চাতে ঢেউ আর ঢেউ, অগণিত অনন্য; মহাসাগরের বুকে মিশে যেতে চায় সাগর আর উপসাগর — অনাদি কাল থেকে তাদের অভিসার যাত্রা। ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্যসাগরের ত্রিকোণ প্রেমের জলধারায় নীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী। বড়দিন-ই বটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি; দেখলেন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, তারপর অতুল্য কিন্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক অধ্যাত্মিক সংকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলো — ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বর।

যে খ্রীস্টান ধর্ম মানুষকে ‘পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীজিই করেন নি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবও। মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম; সে পাপী হবে কীভাবে? সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ; পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজের শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দু বিধবা আশ্রমের জন্য তিনি বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে টাকা তুলে পাঠিয়েছেন কেবল খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ভারতীয় বিদূষী মহিলা রামাবাইয়ের তৈরি বিধবা আশ্রমকে ঔচিত্য দেখানোর জন্য। কারণ এই মহিলাসহ অন্যান্য খ্রীস্ট-ধর্মাবলম্বী ও মিশনারিরা গলা মিলিয়ে ভারতীয় বিধবাদের দুঃখের অতিরঞ্জন করতেন, স্বামীজির তা না-পসন্দ ছিল।

হিন্দু ধর্মের প্রচারে আনুকূল্য পাবার জন্য যতটুকু যীশু-ভজনা দরকার, আমরা লক্ষ্য করছি, স্বামীজি তাই করেছেন। হয়তো তিনি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবমহামণ্ডলে ভারতসহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ। তাই বড়দিনের মত দিনটির মধ্যে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনের বীজ বপন করে দিলেন তিনি। এটা কলোনিয়াল প্রভাবমুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ শে ডিসেম্বরকে অতিক্রমের। এই দিনে বরং বেশী করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পূজন জরুরী। জরুরী শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি যুগলবন্দীর আরাধনা।

কল্যাণ গৌতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.