ছোটবেলায় ভোরে উঠেই খালি পায়ে দৌড়াতে যেতেন ধানক্ষেতের এবড়ো থেবড়ো মাটিতে। সকালে উঠেই তাঁর দোড়ানোর কাজ। এই লড়াই শুরু হয়েছিল যান আমি দিয়ে। শুরুর লড়াইকে যতটা শত্রু ছিল বর্তমানে লড়াইটা তার থেকে আরও অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। দোড়াতে গেলে প্রয়োজন পড়ে একটু পুষ্টিকর খাবার। সিদ্ধ ডিম কিংবা টাটকা ফল তো দূর কোনদিন মুড়ি আবার কোনদিন বা পান্ডা খেয়ে প্র্যাকটিস করেন বাংলার সোনার মেনো বুল্টি রায়। আবার কখনো বা সারা দিন কাটে দুপুরে একটু শাক ভাত খেয়ে । বর্তমানে এই মেয়ে বাংলার গর্ব, কিছু মাস আগেই তারকেশ্বরের বৃষ্টি রায় চেন্নাইতে আয়োজিত ৪২তম জাতীয় মাস্টার্স অ্যারনেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে জিতে নিয়েছেন তিনটি সোনা। মাঠে দৌড়াতে যাওয়ার জন্য নেই ভালো পোশাক না আছে ন্যূনতম ভালো একটি জুতো। শুধু আছে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার মনের জোর। স্বামী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে টালির চালের এক চিলতে ঘরে বাস। দুবেলা ভালো করে যাওয়া জোটে না। মাঠে নামলে যে জেতার খিদে তৈরি হয় তা অনায়াসে হারিয়ে দেয় তাঁর পেটের খিদেকে। বাংলার তারকেশ্বরের এই বৃন্চি রায়ের লড়াই আপনার চোখে জল
আনবে তাঁর জেন এবং অদম্য সাহস দেখে কুর্নিশ জানাতে বাধা হবেন।
গরু বিক্রি করে প্র্যাকটিসের জামা জুতো কেনেন জাঙ্গিপাড়ায় বাবার কাছে চরম অভাবে মানুষ হয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে এসেও সেই একই অবস্থা। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত চরম অভাব তাঁর পিছু ছাড়েনি। বাবা মা চাষ করেই সংসার চালাতেন। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা, সেখানে মেয়ের প্র্যাকটিসের জন্য পোশাক কিংবা জুতো কেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। চার বোন এক ভাই। পেটের ভাত জোগাতেই হিমশিম খেতেন বুল্টির গরিব বাবা মা। কিন্তু বৃষ্টি ফোন ধরেছিলেন যাই হয়ে থাক, তিনি খেলবেন। তাঁর ক্ষেতমজুর বাবা গরু বিক্রি করে সেই ঢাকায় তাঁর জন্য গেলি প্যান্টি আর জুতোর ব্যবস্থা করেন।
৯ বছর কোনো প্র্যাকটিস ছাড়াই প্রতিযোগিতায় প্রথম
প্রথম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত যতবার স্কুলে প্রতিযোগিতা হত সব সময়ের জন্য দৌড়ে ফার্স্ট হতেন বৃষ্টি। মাধ্যমিক দিয়ে বিয়ে করে নেন। স্বামী ট্রেনে হকারি করেন। এক্ষেত্রে যৎসামান্য আয়ে সংসার চালানো বেশ কাকের। বৃষ্টি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ কঠিন মুহূর্তেই পাশে পেয়েছেন স্বামীকে। বিয়ের পর মাঠ ছেড়ে সরাসরি ঢুকে পড়েন একেবারে সংসারিক জীবনে। দুই সন্তান নিয়ে কেটে যায় প্রায় নয় বছর। যখন ছেলের আড়াই বছর বয়স তখন পৌরসভার এলাকার একটি কম্পিটিশনে তাঁকে খেলতে বলা হয়। নয় বছর মাঠের প্র্যাকটিস থেকে একেবারেই দূরে ছিলেন। কিন্তু খেলা যে তাঁর রক্ত আর মনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হন। আগে যে সারি প্র্যাকটিস করাতেন তিনি বলেন মাঝখানে না বছর যাওয়ার হয়ে গিয়েছে আবার যেন জুটি মাঠে পুরো দমে প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন। তারপরে যোগ দেন বেঙ্গল মিচে
সেখানেও জেতেন তিনটে গোল্ড।
দুই সম্ভানকে সামনে কীভাবে প্র্যাকটিসের সময় বার করেন?
কিন্তু সমস্যা যেন তাঁর পিছে ছাড়ে না। সেই স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর দুই বাচ্চাকে নিয়ে মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিস করা কিংবা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া একেবারেই সহজ নয়। ওদিকে স্বামী ট্রেনের হকারি করেন তিনিও সংসারের দিকে সময় দিতে গিয়ে আয় কমে যায়। মুশো থেকে মাত্র আড়াইশ টাকায় সংসার কি আদৌ চলে? বেশিরভাগ দিন না খেয়ে তিনি মাঠে প্র্যাকটিসে যেতেন। কারণ দুই বাচ্চার কথা ভারতে হবে। তিনি যতই একজন অ্যাথলিট হোক না কেন, তিনি কিন্তু একজন মা। বাচ্চা দুটিকে বাড়িতে রেখে মাঠে গেলে মন পড়ে থাকত বাড়িতে। অবশেষে সাথে স্বামীও যেতে শুরু করেন। দিনের পর দিন কাটিয়েছেন আলু সিদ্ধ ভাত খেয়ে। বেঙ্গল মিটের পর ডাক আসে চেন্নাই থেকে।
খেলতে হবে ন্যাশনাল লেভেলে সমস্ত খরচ প্রতিযোগীর। কিন্তু বুদির একটা ভালো জুতোও ছিল না, তার উপর রয়েছে গাড়ি ভাড়ার টাকা, এমনকি ন্যূনতম খাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেই। সেখানে তিনি কীভাবে যাবেন ন্যাশনালে খেলতে? এত কিছু অনিশ্চয়তার মধ্যেও দুবেলা প্রাকটিস করতে ভোলেননি। বৃষ্টিকে অনেকে ফোন করতেন। কিন্তু কেউ বাড়িতে আসতেন না। অবশেষে একজন বাড়িতে এসে কিছু টাকা দিয়ে যান। তারপর বৃষ্টি যান ক্লাবের চেয়ারম্যানের কাছে। তিনিও কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। বহু মানুষ চেন্নাই যেতে তাঁকে সাহায্য করেছেন। আসলে এই সাহায্য কিন্তু হাত পেতে নেওয়া কোন সাহায্য নয়, একজন মহিলা যাতে তাঁর সংসার সামলে প্রতিভাকে সবার সামনে তুলে ধরতে পারেন তার সহযোগিতার প্রয়াস মাত্র।
অঝোরে কেঁদে ফেলেন দিদি নম্বর ওয়ানের মঞ্চে
যদি তারকেশ্বরের পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণ বাজার এলাকায় যান সেখানে দেখবেন দুই সন্তান আর স্বামী নিয়ে বছর ৩০ এর বুদ্ধির ছোট্ট টালির ঘরে সংসার। দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। স্বামী বেশিরভাগ দিনেই ট্রেনে শসা বিক্রি করেন। সেই দিয়ে আছ আর কত হয়। দিনে পাতে একটা আগ ডিম পড়াই মুশকিল, সেখানে এনার্জি ড্রিঙ্ক কিংবা দুধ একেবারে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের মত। কিছুদিন আগেই বৃষ্টিকেই দেখা গিয়েছিল দিদি নাম্বার ওয়ানের মঞ্চে। সেখানেও তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন তাঁর জীবন লড়াইয়ের গল্প বলতে কাতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেদিন শুধু তিনি কাঁদেননি, কেঁদে ছিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা অভিনেত্রী রচনা ব্যানার্জীর সহ বাংলার কোটি কোটি দর্শক। রচনা ব্যানার্জি বৃষ্টিকে ৫০ হাজার টাকার দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেছেন। বর্তমানে বুন্টিটি স্বপ্ন দেখছে মালয়েশিয়া যাওয়ার, সেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে চান। কিন্তু প্রয়োজন প্রায় দু লক্ষ টাকা। যেটা তাঁর একার পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে ভোলেননি বাংলার গর্ব বৃষ্টি রায়, সংসার সামলে নিয়মিত করে যাচ্ছেন প্র্যাকটিস।