সপ্তাহের গোড়া থেকে তুমুল বর্ষণে ভাসছে উত্তর ভারতের বিশাল এলাকা। পাহাড়ের বৃষ্টি প্রাণ নিয়েছে। ধস নামিয়েছে। আর লাগোয়া যমুনা নদীর জল বেড়ে ভেসে গিয়েছে রাজধানী দিল্লির একটা বড় এলাকা। কিন্তু বিপর্যয়ে কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস!
শুক্রবার দুপুর
অফিস গ্রুপে মেসেজ এল, যমুনার জল সুপ্রিম কোর্ট পৌঁছেছে! যে রিপোর্টার মেসেজটি পাঠিয়েছেন, তিনি তখন সুপ্রিম কোর্ট হয়ে নয়াদিল্লি স্টেশন পেরিয়ে লালকেল্লার পিছনের রাস্তা ধরে কাশ্মীরি গেট পৌঁছনোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই গোটা রাস্তাটাই তখন নদীর চেহারা নিয়েছে। ‘সুপ্রিম কোর্ট’ দেখেই গ্রুপে রসিক কোর্ট রিপোর্টারের পাল্টা প্রশ্ন, ‘যমুনা কোন বেঞ্চে গেলেন? পিআইএল?’
পিআইএল না হলেও যমুনার জলে দিল্লির একটা অংশ ভেসে যাওয়ার পর কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে তীব্র ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। দু’পক্ষেরই ভাবটা এমন যে, তাদের চিঠি দিয়ে যমুনার জলে ভাসানোর কথা ছিল! জলের স্তর যত বাড়ছে, টেলিভিশনে উত্তেজিত বাক্যবিনিময় ততই ‘মধুর’ থেকে ‘মধুরতর’ হচ্ছে। দিল্লির টেলিভিশন রিপোর্টারদের পোয়া বারো! বছর তিনেক আগে এই রিপোর্টারদেরই অনেকে লেহ্ পৌঁছেছিলেন গালওয়ান সংঘর্ষের সরাসরি কভারেজ করতে। লেহ্ থেকে গালওয়ান প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এখনও মনে আছে, লেহ্-র হোটেলে ছাদের উপর টেবিল। তার উপর চেয়ার তুলে দিব্যি ‘গ্রাউন্ড জিরো রিপোর্টিং’ করছিলেন তাঁরা। সুযোগমতো তাঁদেরই অনেকে নেমে পড়েছেন কৃষ্ণলীলার জলে। কোমরজলে দাঁড়িয়ে মাস্কারা পরিহিতা কখনও ‘টাইটানিক’, কখনো ‘লাইফ অফ পাই’ বর্ণনা করছেন। জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ২৪ ঘণ্টায় দিল্লির ২৫টি বুলেটিন করছে।
লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ১ নম্বর গেটে নেমে জামা মসজিদকে পিঠে রেখে সামান্য এগিয়ে ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়তে পারলেই বেশ একটা মেলার চেহারা। রিং রোডের এই অংশ বন্ধ। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে আইটিও-র দিকে। সামান্য এগিয়ে বাঁ’দিকের রাস্তা ঘুরে গিয়েছে রাজঘাটে। সেখান থেকে খানিক দূরে যমুনা নদী। গোটা অঞ্চলেই এখন জল। পুরনো রেলব্রিজ পার করলেই গাদা গাদা ওবি ভ্যান। স্থানীয় মানুষ হাঁটুর উপর ট্রাউজার্স গুটিয়ে জটলায় জটলায় বিভক্ত। বুম-হাতে রিপোর্টার দেখলেই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন পুরীর পাণ্ডার মতো। রফা হচ্ছে ঘণ্টায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে তাঁরা ‘বোট রাইড’ দিচ্ছেন। ঘুরে দেখা যাবে দু’একটি গলি। কোমরজলে দাঁড়িয়ে স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য পাঁচ-সাতজন লোকেরও ব্যবস্থা করে দেবেন তাঁরাই। ফুটেজও মিলছে নাটকীয়! চাকাডোবা জলে রিকশাচালক নৌকা চালানোর অভিনয় করছেন। ডিভাইডার থেকে জলে ঝাঁপ মারছে খোকা। হাঁটুজলে দরজায় দাঁড়িয়ে মহল্লা। দিল্লির বন্যায় এমন ‘ফুটেজ’ বর্ষাকালে দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মতো।
শনিবার সকাল
চেন্নাই থেকে সম্পর্কে এক দাদা হর্ষ ভ্যাটস নামক জনৈকের জনান্তিতে ছাড়া একটি টুইট শেয়ার করল। মিনিয়েচার পেন্টিংয়ের স্টাইলে মোগল আমলের ছবির কয়েকটি ক্লিপিংয়ের প্রেক্ষিতে বর্তমান দিল্লি। দেখা যাচ্ছে, এখন যেখানে বন্যা, লালকেল্লার পিছনের সেই অংশ দিয়ে এক সময় কুলকুল করে বয়ে যেত যমুনা। পাশাপাশি রাখলে ছবিগুলো ফ্রেম বাই ফ্রেম মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব। হর্ষের টুইট বেশ ভাইরাল হয়েছে সমাজমাধ্যমে। সে সব ভাইরালে বহু সময়েই ভাইরাস থাকে। আমরা জানি। হর্ষের টুইটে আছে কি না জানি না। তবে ছবিগুলো দেখতে মন্দ নয়। জেএনইউয়ের এক অধ্যাপককে পাঠিয়েছিলাম লিঙ্কটা। এখনও উত্তর আসেনি। জেএনইউয়ের সিলেবাস থেকেও কি মোগল ইতিহাস বাদ পড়েছে? তবে কাজের কথা এই যে, গেরুয়া বর্তমান এবং মোগল রাজধানীর ওই অতীত ছবির বৈপরীত্য দেখে এখনও কেউ লাভ জিহাদ, ছবি জিহাদ, যমুনা’জির অপমান, মোগল আগ্রাসন জাতীয় ‘হ্যাশট্যাগ’ বাজারে ছাড়েননি। ছাড়লে জাতীয় টেলিভিশনের সেটা প্রাইম টাইমে তুলে নিতে বড়জোর সাড়ে তিন মিনিট সময় লাগবে।
শনিবার দুপুর
যেখানে থাকি, সেই সোসাইটির হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ জানাল, পরের দু’দিন (রবি এবং সোমবার) জলের সমস্যা হতে পারে। দক্ষিণ দিল্লি পুরসভার তরফে পাড়ার মাতব্বরদের তেমনই জানানো হয়েছে। কিন্তু কেন থাকবে না জল, তা স্পষ্ট নয়। সকলেই ধরে নিচ্ছেন, যমুনার জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে বলেই হয়তো পুরসভার এই ঘোষণা। শোনা যাচ্ছে, যমুনার জল পরিশোধনাগারগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এই বন্যা পরিস্থিতির জন্য অন্তত এটুকু জানা গেল, যমুনার জলেরও পরিশোধন হয়! সারা বছর নদীটার চেহারা দেখলে পরিশোধনাগারের উপস্থিতি বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব! বন্যার কিছুদিন আগেও এক সহকর্মী হাতে কোনও খবর নেই বলে যমুনায় পৌঁছে গিয়েছিল। খবর এনেছিল— যমুনার কালো জলে দূষণের ফোম ভেসে বেড়াচ্ছে। এই খবর আগে কয়েক লক্ষ বার হয়েছে। আরও কয়েক লক্ষ বার হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাবে না। এ কথা সকলেই জানেন। যেমন অনেকে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন, যমুনার গোটা যাত্রাপথের মাত্র ২২ কিলোমিটার দিল্লির উপর দিয়ে যায়। এই ২ শতাংশ যাত্রাপথে যমুনার দূষণমাত্রা ৭৫ শতাংশ! অবশ্য রাজধানীর অবদান একটু বেশি তো হবেই!
শনিবার বিকেল
ঘন মেঘ আর প্যাচপ্যাচে ঘাম। রাজঘাটের কাছে নৌকা। সাংবাদিককে টপকে এক ব্যক্তি কলসিভর্তি ছাই ভাসিয়ে দিলেন রিং রোডের জলে। তিনবার মাথায় ছেটালেন বন্যার জল। মুখে, ‘যমুনা মাঈ কি…।’ চকিতে গাড়িতে উঠে পড়লেন তিনি। মোবাইল ক্যামেরা খুলতে খুলতে বৃষ্টি নামল তেড়ে। টিউবলাইটের মতো বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল গাড়ি। এমন অবিশ্বাস্য বৃষ্টি, এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্য, এমন অবিশ্বাস্য বন্যা, এমন অবিশ্বাস্য বিশ্বাস!
শনিবার রাত
নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলছে। শুক্রবারই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যমুনা লাগোয়া শ্মশানঘাট, স্কুল-কলেজ-অফিস। দিল্লি থেকে নয়ডা যাওয়ার একটা রাস্তা বন্ধ করার খবর এল। পুরসভার টুইট জানিয়ে দিল, আগামী দেড় দিন কোন কোন রাস্তা বন্ধ থাকবে রাজধানীর। যার অধিকাংশই মোগল এবং সুলতানি আমলের বাদশাহদের নামে। যমুনার জল এখনও বিপদসীমার উপরে। তবে আগের চেয়ে সামান্য নেমেছে। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, দিল্লিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও বৃষ্টি হবে। পাহাড়ে আগামী তিনদিন অতি থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে। হিমাচল, উত্তরাখণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস সত্যি হলে আমার বাসস্থান এই দক্ষিণ দিল্লিতেও রবার বোটের সন্ধান নিয়ে রাখা ভাল মনে হচ্ছিল। ওখলা পাখিরালয়ের কাছেও যমুনার জল ফুলছে। কখন কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না! পাড়ার গ্রুপে জনৈক হেঁসেলের ছবি পোস্ট করেছেন। সে ছবি বলছে, অন্তত এক সপ্তাহের বাজার তুলে এনেছেন রান্নাঘরে। টমেটো সাড়ে ৪০০ টাকায় পৌঁছেছে।
রবিবার ভোর
বৃষ্টি হচ্ছে। তবে হাল্কা। ট্যাঙ্কে জল নেই। বাড়িতে কাজের সহায়ক ছুটি নিয়েছেন। পাড়ায় অনেকের বাড়িতেই একই সমস্যা। মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন বাতিল হয়েছে। গুরুগ্রামে মদের দোকানে ঠেলাঠেলি ভিড়। মথুরায় বন্যা পরিস্থিতি। গুগল অ্যালার্ট বলছে, দিল্লিতে যমুনার জল ২০৬.০২ মিটার উচ্চতায় বইছে। আগের চেয়ে সামান্য কমলেও বিপদসীমার উপরে। বিকেলের দিকে জল আবার বাড়তে পারে। হাতিকুণ্ডের জল কেন কেবল দিল্লিতেই ঢুকছে, উত্তরপ্রদেশ আর হরিয়ানায় কেন যাচ্ছে না, তা নিয়ে দেড়হাজার শব্দের উত্তর সম্পাদকীয় বেরিয়েছে রবিবারের কাগজে। যা দেখে আপ-পন্থীর উপসংহার— দিল্লি বঞ্চনার শিকার। কারণ, উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানা বিজেপি-শাসিত। টেলিভিশন স্টুডিও জলে ছিল। জলেই আছে। কোট-টাই পরিহিত অ্যাঙ্করদের মুখ বদলেছে। রবিবার সিনিয়রদের ছুটি। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী কেজরীওয়াল একটিও টুইট করেননি। সহকর্মী সাংবাদিক বাঙালি পাড়ায় এসেছেন লুচির খোঁজে। এই সাংবাদিকই সেদিন গ্রুপে প্রশ্ন করেছিলেন, যমুনা সুপ্রিম কোর্টের কোন বেঞ্চে গিয়েছে? কথায় কথায় সেই প্রসঙ্গও উঠল। শুনলাম, ২০২০ সালে যমুনার দূষণ নিয়ে ‘যমুনা মনিটরিং কমিটি’ (ওয়াইএমসি) রিপোর্ট পেশ করেছিল। ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছিল, দিল্লিতে যমুনার দূষণের মাত্রা মোট দূষণের ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সালে ওই কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছে। কেন তোলা হল, তা নিয়ে নানা বিতর্ক। যাবে-যাবে করেও মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এখনও গড়ায়নি। এবার গড়াবে? ‘যমুনা ফ্লাডল্যান্ড’-এর দিল্লি এবার কি একটু সতর্ক হবে? আদালত সাংবাদিক লুচিতে মন দিলেন।
রবিবার বেলা ১১টা
আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখা গোটানোর মুহূর্তে কলকাতার এক বন্ধু দিল্লি বন্যার একটি ‘রিল’ শেয়ার করল। একদিকে কলকাতার অ্যাকোয়াটিকা। অন্যদিকে রবিবারের রিং রোডে জলকেলি। পটভূমিকায় বাজছে, ‘কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা?’