কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দুই দশকের সমস্যার সমাধান, ত্রিপুরায় স্থায়ী ঠিকানা পেলেন রিয়াং শরণার্থীগণ

 অনিশ্চিয়তার কালোমেঘ এক সময় ঠিকই কেটে যায়। তাতে প্রয়োজন হয় ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ় মানসিকতা। তাই, রিয়াং শরণার্থীদের চোখেমুখে তাঁদের এখন নিশ্চয়তার ছাপ৷ দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর নিদারুণ দুঃখ, কষ্ট দুর্দশার শেষে নিজের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মেরও নিশ্চয়তা পেয়েছেন তাঁরা। পেয়েছেন স্থায়ী ঠিকানা। মুছে গেছে নিজ দেশে শরণার্থী নামের তকমা৷ তাঁরা আজ আনন্দে আপ্লুত। কৃতজ্ঞও বটে। তাঁরা কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের প্রতি। কারণ তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই দীর্ঘ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে মিজোরামে জাতি বিরোধের শিকার হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল কয়েক হাজার রিয়াং জনজাতি অংশের মানুষ। উদ্বাস্তু হিসেবে তাঁদের স্থান হয়েছিল অবিভক্ত কাঞ্চনপুর মহকুমার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। এখন তারা ত্রিপুরার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসন পাচ্ছেন। 
হয়তো ত্রিপুরার ভবিষ্যত বদলানোর উদ্দেশ্যেই ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ত্রিপুরাবাসীর পাশাপাশি রিয়াং শরণার্থীদের ভাগ্যাকাশে সোনালী রৌদ্র দেখা দিতে শুরু করে তখন থেকেই। দীর্ঘ দু’দশক সময় ধরে কেউ কল্পনাও করেনি তাঁদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য একটি সরকার এতটা মরিয়া হয়ে উঠবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বিপ্লব কুমার দেব রিয়াং শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার দেন। 
কেন্দ্রীয় সরকার, ত্রিপুরা সরকার, মিজোরাম সরকার ও রিয়াং শরণার্থী প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার পর কয়েক শতাধিক পরিবার নিজ ভূমিতে ফিরে যান৷ কিন্তু একটা বড় অংশ নতুন করে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় মিজোরামে ফিরে যেতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। যে কারণে তাঁদের কীভাবে পুনর্বাসন দেওয়া যায় সেটা নিয়ে নতুনভাবে প্রশাসনিক চিন্তাধারা শুরু হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুরু হয় কেন্দ্রীয় সরকার, ত্রিপুরা সরকার, মিজোরাম সরকার ও রিয়াং শরণার্থী প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা। দফায় দফায় আলোচনা ও বৈঠক শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার, ত্রিপুরা সরকার, মিজোরাম সরকার ও ব্রু রিপ্রেজেন্টেটিভ অর্গানাইজেশনের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত শুরু হয় ত্রিপুরার মাটিতে রিয়াং শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া৷ 
গত ১৯ এপ্রিল কাঞ্চনপুর ও পানিসাগর মহকুমা থেকে ৮ শতাধিক রিয়াং শরণার্থী পরিবারকে স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগর মহকুমার কাসকাউ ও ওয়াইবাকছড়া রানিছড়া এবং ধলাই জেলার লংতরাইভ্যালি ও আমবাসা মহকুমায় নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ধলাই জেলায় রয়েছে চার শতাধিক পরিবার। রাজ্য প্রশাসনের এই উদ্যোগে নবজন্ম পেয়েছেন রিয়াং শরণার্থীগণ। তাইতো তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে রাজ্য সরকারের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। অবশ্যই, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিও তাঁরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। লংতরাইভ্যালি মহকুমা সদর ছৈলেংটা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গড়ে দেওয়া হয়েছে শরণার্থীদের থাকার অস্থায়ী ব্যারাক। প্রকৃতির কোলে লবণছড়া এডিসি ভিলেজের বঙ্গাফা পাড়ার পাহাড়ি এলাকায় একসঙ্গে মোট ১০টি টিনের ছাউনি দেওয়া ব্যারাক নির্মাণ করে দিয়েছে প্রশাসন। প্রত্যেকটিতে পানীয়জল ও শৌচালয়ের সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই শিবিরে আপাতত ২০৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেকের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ৯ কেজি চাল ও এক কেজি লবণ দেওয়া হয়েছে। 
এছাড়া প্রত্যেকদিন দুবেলা করে আপাতত প্যাকেট করা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে। সবজি সহ রান্নার অন্যান্য সামগ্রীও সরবরাহ করা হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের এই ঐকান্তিক প্রয়াসে আপ্লুত রিয়াং শরনার্থীরা। কীভাবে তাঁরা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাবেন সেটাই যেন ভেবে পাচ্ছেন না। বঙ্গাফাপাড়া ক্যাম্পের ব্লু ডিসপ্লেসড সেটেলমেন্ট কমিটির সেক্রেটারি ই জে চরকি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্ররমন্ত্রী এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পাশাপাশি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সেই সাথে সুদীর্ঘ এত বছর ধরে তাঁদের ওপর চলা নানা দুঃখ দুর্দশার কথা অকপটে তুলে ধরেছেন তাঁরা। জজিরাম চরকি, কালাজয় রিয়াং, ধনুরাম মেসকা, প্রদীপ রিয়াং, কিরাধন রিয়াংরা নয়া ঠিকানা পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। একবাক্যে সবাই জানালেন বর্তমানে প্রশাসনের সহায়তায় তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। 
একই চিত্র ধরা পড়েছে আমবাসা মহকুমার হাদুকলাউ পুনর্বাসন ক্যাম্পেও৷ পুনর্বাসন, সরকারি সাহায্য, গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা হয় এই ক্যাম্পের সেক্রেটারি উত্তম কুমার রিয়াংয়ের সাথে। স্পষ্টতই তিনিও স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। এর পাশাপাশি কথা হয় জোৎসোয়ানা রিয়াং এবং অমিতা রিয়াংয়ের সাথে। তাঁরাও তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। হাদুকলাউ পুনর্বাসন ক্যাম্পে বর্তমানে ২০৭টি পরিবার অবস্থান করছেন। তাঁদের প্রত্যেকের খোঁজখবর নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও মহকুমা প্রশাসনের আধিকারিকগণ। লংতরাইভ্যালি এবং আমবাসা মহকুমার দুটি শিবিরের প্রত্যেকটি ব্যারাকেই রিয়াং জনজাতিদের থাকার সুবিধার জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক পাখা সহ সোলার লাইটেরও ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই আশায় বুধ বেঁধে আছেন আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সরকারি সহায়তায় তাঁরা ব্যারাক-জীবন ছেড়ে নিজের মতো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.