‘পুলিশ’ লেখা টি-শার্ট এবং বাইক ব্যবহার করতেন আরজি করের ধর্ষক-খুনি! কিসের প্রশ্রয়ে, উঠছে প্রশ্ন

কখনও সিভিক ভলান্টিয়ার, কখনও পুলিশ, কখনও আবার বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কর্মী! ‘কলকাতা পুলিশ’ লেখা গাড়ি, বাইকও ছিল তাঁর। সেই বাইক নিয়েই ছিল হাসপাতালে নিত্য যাতায়াত। নিজের এলাকাতেও ‘পুলিশ’ লেখা টি-শার্ট পরে দাপট নিয়েই ঘুরে বেড়াতেন তিনি। অথচ পুলিশের ঠিক কোন্ পদে কর্মরত ছিলেন অভিযুক্ত, জানতেন না কেউই!

এমনই সব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আরজি করে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় অভিযুক্তের নামে। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক পড়ুয়াকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় ইতিমধ্যেই এক জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হাতে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও। তা থেকেই জানা যাচ্ছে, পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার হলেও যথেষ্ট ‘প্রভাবশালী’ ছিলেন অভিযুক্ত। পুলিশের গাড়ি-বাইক চড়েই ঘুরে বেড়াতেন। সেই বাইক নিয়ে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। নিজেকে সরাসরি ‘পুলিশ’ বলেই পরিচয় দিতেন তিনি। এমনকি, তাঁর হাবভাব দেখে অন্যান্য সিভিক ভলান্টিয়ারেরা ভাবতেন, তিনি হয়তো সত্যিই হোমগার্ড!

এলাকাতেও ছিল দেখনসই চালচলন! সঙ্গে মহিলাদের উত্যক্ত করা, তোলাবাজি, এ সব তো ছিল বলেই অভিযোগ। প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন, ‘‘আমিই তো পুলিশ!’’ তাঁর ‘দাপটে’ সিঁটিয়ে থাকতেন সকলেই। ধৃত যুবকের মা-ও জানাচ্ছেন, কখনও দক্ষিণ কলকাতায় নিজের বাড়িতে, কখনও ফোর্থ ব্যাটালিয়নের ব্যারাকে থাকতেন ছেলে। সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও পুলিশের জন্য নির্দিষ্ট ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে কী ভাবে থাকার অনুমতি পেলেন ধৃত, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। এই সবের জেরেই মনে করা হচ্ছে, আর পাঁচ জন সিভিক ভলান্টিয়ারের তুলনায় ‘আলাদা চোখে’ দেখা হত অভিযুক্তকে। আরজি করের নিরাপত্তারক্ষীরা জানাচ্ছেন, হাসপাতালেও ছিল তাঁর নিত্য যাতায়াত। মনে করা হচ্ছে, হাসপাতালে দালালির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল।

শনিবারই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে দফায় দফায় জেরা করেছে পুলিশ। জেরায় উঠে এসেছে নানা তথ্য। জানা গিয়েছে, ধৃতের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা ছিল। শুরুতেই নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন, অথচ হাবেভাবে ছিল না অনুতাপের ছিটেফোঁটাও। বার বার নির্বিকার ভাবে বলছিলেন, ‘‘ফাঁসি দিলে দিন!’’ মোবাইল ভর্তি ছিল পর্নোগ্রাফিতে। তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, এই সব থেকেই স্পষ্ট যে, অভিযুক্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত। এর পরেই অভিযুক্তকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে শিয়ালদহ আদালত।

শুক্রবার আরজি করের মেডিক্যাল কলেজের চার তলায় সেমিনার হলে এক মহিলা চিকিৎসকের রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার থেকেই প্রতিবাদে প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন সারা রাজ্যের চিকিৎসকেরা। রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষও। দোষীদের শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছেন বিরোধী নেতৃত্ব। শাসকদল তৃণমূলও ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সঠিক তদন্তের দাবি করেছে। চিকিৎসক ও আমজনতার বিক্ষোভ কলকাতা পেরিয়ে ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের জেলায় জেলায়।

ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরা না থাকলেও তার আশপাশে এবং হাসপাতাল চত্বরের সিসিটিভির বিভিন্ন ফুটেজ খতিয়ে দেখে শুক্রবার রাতেই সন্দেহভাজন ওই যুবককে লালবাজারে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার ওই যুবক কী ভাবে সকলের চোখের আড়ালে হাসপাতালে ঢুকলেন, তার পর চার তলায় উঠে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাল‌েন, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রশ্নের মুখে হাসপাতালের নিরাপত্তাও। লালবাজার এই ঘটনার তদন্তে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে। সেই তদন্তেই দিনভর উঠে এসেছে ঘটনার একের পর এক নৃশংসতার ছবি। মৃতার দেহের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও অত্যাচার করে খুনের প্রমাণ মিলেছে। রিপোর্ট বলছে, মৃতার শরীরের একাধিক অংশে মিলেছে ক্ষতের চিহ্ন। ডান হাতের অনামিকা ভাঙা। মুখে, ঠোঁটে, হাতে-পায়ে, পেটে, এমনকি যৌনাঙ্গেও আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। গলার দু’পাশের হাড় ভেঙে গিয়েছে। দু’চোখ থেকেও বেরিয়ে এসেছে রক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.