পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বে রাজ্যের কিছু সংখ্যালঘু এলাকায় গোলমাল হয়েছিল। মনোনয়ন জমা দিতে না-দেওয়া বা হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনায় ওই সব এলাকায় তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাত বেধেছিল বিরোধীদের। শনিবার, পঞ্চায়েত ভোটের দিনও রাজ্যের কিছু সংখ্যালঘু এলাকায় ‘প্রতিরোধ’-এর মুখে পড়তে হয়েছে তৃণমূলকে। তার ফলে কি চিন্তিত রাজ্যের শাসক শিবির?
ভোটের দিন মোট আট জন তৃণমূল কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভোটের দিন তাদের এত জন প্রাণ হারাচ্ছেন, এটা গত ১১-১২ বছরে তৃণমূলের শাসনকালে দেখা যায়নি। যেমন এমনও দেখা যায়নি যে, সংখ্যালঘু এলাকায় তৃণমূল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। সে ভোটের আগে মনোনয়ন পর্বেই হোক বা ভোটের দিন।
নওশাদ সিদ্দিকিদের আইএসএফের ‘উত্থান’ নিয়েও সংখ্যালঘুদের বারবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছে তৃণমূল। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার আইএসএফকে ‘হায়দরাবাদের দলের মতো ভোটকাটুয়া’ (আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল ‘মিম’) বলে আক্রমণ শানিয়েছেন। কখনও সরাসরি বলেছেন, ‘‘বিজেপির দালাল!’’ কিন্তু আইএসএফের সঙ্গে ভাঙড়ে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে শাসকদল। তৃমমূলের সঙ্গে এতটাই টক্কর দিয়েছে আইএসএফ, যে সেখানে তৃণমূলকে ‘প্রতিরোধ’-এর তত্ত্ব খাড়া করতে হয়েছে। বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ভাঙড়ের বাইরে থেকে বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্তকে নিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নওশাদের ‘দাপট’ কমেনি। ভোটের দিন এবং তার পরদিন, রবিবারেও উত্তর ২৪ পরগনা এবং হুগলির বিভিন্ন এলাকায় আইএসএফের সদস্য-সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূলের সংঘর্ষ হয়েছে।
এটি কি সংখ্যালঘুদের তৃণমূলের প্রতি সমর্থন সংক্রান্ত কোনও ‘সূচক’?
তৃণমূল অবশ্য তা মানতে চায়নি। তারা ওই সব ঘটনাবলিকে ‘বিক্ষিপ্ত’ হিসাবেই দেখাতে চেয়েছে। দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ রবিবার বলেন, ‘‘সিপিএমের কিছু প্রাক্তন হার্মাদ, কংগ্রেস, আইএসএফ মিলে টার্গেট করে করে আমাদের লোকেদের খুন করেছে! এর সঙ্গে ব়ৃহত্তর আঙ্গিকের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক জামির মোল্লার অবশ্য দাবি, ‘‘সংখ্যালঘুদের চিরকালই ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে দেখে তৃণমূল। কিন্তু এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের এনআরসি-র জুজু দেখিয়ে তৃণমূল আর পার পাবে না।’’ কংগ্রেসনেতা সৌম্য আইচ রায়ের কথায়, ‘‘তৃণমূল সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণার রাজনীতি করছে। কিছু মানুষকে অল্পদিনের জন্য বোকা বানানো যায়। কিন্তু তাঁদের চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ভোটের ফলপ্রকাশের পর বোঝা যাবে আদৌ এই প্রতিরোধ কতটা কার্যকরী হয়েছে। যদি দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে তৃণমূলের ভোট ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের তুলনায় কমেছে, একমাত্র তা হলেই তা শাসকদলের জন্য চিন্তার কারণ হবে। যদি দেখা যায় তা হয়নি, তা হলে বুঝতে হবে ওই প্রতিরোধের কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই।’’ তবে একইসঙ্গে বিশ্বনাথ এ-ও বলেন যে, ত়ৃণমূল জমানায় এমন ঘটনা বা এই চিত্র এর আগে দেখা যায়নি।
মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফলাফলে চিন্তা দেখা গিয়েছিল শাসকদলে। কারণ, সাগরদিঘিতেই তৃণমূলের সংখ্যালঘু সমর্থন পাওয়ার ‘ধারাবাহিকতা’ ধাক্কা খেয়েছিল। সংখ্যালঘু গরিষ্ঠ সেই কেন্দ্রে কংগ্রেস-সিপিএম জোট প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের কাছে হেরেছিলেন তৃণমূলের প্রার্থী। যা থেকে বিরোধী সিপিএম-কংগ্রেস এমন ধারণা তৈরি করতে চেয়েছিল যে, সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। অন্কেই বলেছিলেন, সংখ্যালঘু ভোটও ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ হয়ে যাচ্ছে। অথবা ঘুরিয়ে বললে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য নয় যে, যদিও সেই ভোটের পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মন্ত্রিসভার সংখ্যালঘু সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই কমিটি তাদের রিপোর্টও দিয়েছিল। তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যানও বদল করে দিয়েছিলেন দলনেত্রী।
অবশ্য তিন মাসের মধ্যে বাইরন তৃণমূলে যোগ দেন। তখন অনেকেই বলেছিলেন, তৃণমূল ঘুরিয়ে সংখ্যালঘুদের বার্তা দিল যে, অন্য প্রতীকে ভোট দিয়ে লাভ নেই। জিতলেও সংশ্লিষ্ট বিধায়ক বা নেতা সেই তৃণমূলেই আসবেন! পঞ্চায়েত ভোটের আগে কুণালও বলেছিলেন, ‘‘অন্য প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জিতিয়ে কোনও লাভ হবে না। শেষমেশ তাঁরা তৃণমূলেই আসবেন।’’
বামেদের দিক থেকে সংখ্যালঘু ভোট যে মমতার দিকে সরে যাচ্ছে, তার প্রথম আভাস মিলেছিল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটেই। তার এক বছর পরে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, মমতা বামেদের সংখ্যালঘু ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। তার পর থেকেই রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে তৃণমূলের কার্যত একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্য অনেক কাজও করেছেন। এতটাই, যে তাঁর বিরুদ্ধে ‘মুসলিম তোষণ’-এর অভিযোগ এনেছে বিরোধী বিজেপি। কিন্তু বিজেপি বলেই সেই অভিযোগ খুব একটা ধোপে টেকেনি। ঠিক সেই সেই কারণেই পঞ্চায়েত ভোটের ঘটনাপ্রবাহকে অনেকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন।
সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় ভোটের দিন তৃণমূলের দু’জন খুন হয়েছেন। দু’জনই সংখ্যালঘু। উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া, মালদহের মানিকচক, নদিয়ার চাপড়ায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই সংখ্যালঘু। বস্তুত, ভোটের দিন মুর্শিদাবাদের নওদায় নিহত কংগ্রেসকর্মীর বাড়িতে গিয়ে রবিবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বারংবার বলেছেন, ‘‘একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে খুন করছে তৃণমূল! যিনি মাত্র তিন দিন আগে হজ করে ফিরেছিলেন।’’ অধীরের বক্তব্যের উদ্দেশ্য একেবারেই অস্পষ্ট নয়।
তবে সংখ্যালঘু ভোট বাক্সে চিরকালই রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য থাকে। বিজেপিও যে সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার চেষ্টা করে না তা নয়। তবে তারা ওই ভোটের উপর ‘নির্ভর’ করে না। কিন্তু তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোটের উপর ‘নির্ভরশীল’। সেই কারণেই নওশাদ তথা আইএসএফের ‘উত্থান’ নিয়ে শাসক শিবিরে সামান্য হলেও একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে ইতিহাস বলছে, সংখ্যালঘু ভোট আচমকা শিবির বদল করে না। কিন্তু করলে ঢেলে বাক্স বদল হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সাচার কমিটির রিপোর্টের অব্যবহিত পরেই বাংলার সংখ্যালঘুরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়নি। তৃণমূলের দিকে ঘুরতে সময় নিয়েছিল। ফলে সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের প্রতি আচমকা পুরোপুরি ‘বিমুখ’ হয়ে পড়বেন, তেমন সম্ভাবনা নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। তাঁদের মতে, বাংলায় প্রধান বিরোধীদল যখন বিজেপি, তখন পঞ্চায়েত ভোটের ঘটনাবলি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো অনুচিত। পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় স্তরে আরও অন্য সমীকরণ কাজ করে।