যাদবপুরের মেন হস্টেলের আবাসিকদের বিরুদ্ধে ‘অত্যাচারের’ অভিযোগ তুললেন পড়শিরা

মধ্য রাতেও তারস্বরে ডিজে বাজিয়ে চলত নাচ-গান। আচমকা সশব্দে ফাটানো হত বাজি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের আবাসিকদের এমনই ‘অত্যাচারে’ রাতের পর রাত কেঁপে কেঁপে উঠত একরত্তি শিশুটি। হস্টেল লাগোয়া পোদ্দারনগরের এক বাসিন্দার অভিযোগ, দিনের পর দিন হস্টেলের আবাসিকদের ‘তাণ্ডবে’ ঘুম উড়েছিল তাঁর এক বছরের নাতনির।

গত ৯ অগস্ট রাতে মেন হস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ ঘিরে আপাতত উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। এরই মধ্যে সেই হস্টেলের আবাসিকদের বিরুদ্ধে মধ্য রাত পর্যন্ত তাণ্ডবের অভিযোগ করেছেন পোদ্দারনগরের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, ছাত্র-মৃত্যুর পরে হস্টেল তুলনায় ‘শান্ত’। তবে তার আগে রাতে চিৎকার-চেঁচামেচি, নাচ-গান, বাজি ফাটানো থেকে আশপাশের মেয়েদের লক্ষ্য করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মদ খেয়ে বোতল ছোড়া— কিছুই বাকি রাখতেন না আবাসিকেরা।

তবে, এই সব অভিযোগ উড়িয়ে মেন হস্টেলের এক আবাসিকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এই অভিযোগ সত্যি হলে ওঁরা আগে জানাননি কেন? এখন একটা ঘটনা ঘটেছে, তার পরে যত দোষ সব আমাদের! বিষয়টা এমন যে, লোহা গরম আছে, তাই তাকে পিটিয়ে দাও।’’ তবে, ভিন্ন মতও রয়েছে। এই সমস্ত অভিযোগের সারবত্তা আছে বলেই মনে করছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া তর্পণ সরকার। তাঁর মতে, ‘‘হস্টেলের তাণ্ডব বন্ধ করতে না পারা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। মেন হস্টেলে যাঁরা এমন কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা আমাদেরই সহপাঠী। যাদবপুরের ছাত্র-শিক্ষকেরা মিলে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারিনি, এটাও আমাদের ব্যর্থতা।’’

মেন হস্টেলের আবাসিকদের বিরুদ্ধে একাধিক অভব্য আচরণের অভিযোগ করছেন সংলগ্ন বাড়িগুলির বাসিন্দারা। কখনও জানলা থেকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, কখনও পুলিশ আবাসনের মহিলাদের লক্ষ্য করে কুকথা— এমনই চলত। আরও অভিযোগ, মৃত সেই পড়ুয়াকেও জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অশালীন কথা চিৎকার করে বলতে বলা হয়। হস্টেল সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বলছেন, ‘‘ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে হস্টেলে র‌্যাগিং হতেও দেখেছি। রাতে ছাত্রাবাসের তেতলার বারান্দায় অন্তর্বাস পরে ছাত্রকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এক হাতে কান ধরে, অন্য হাতে জানলার গ্রিল ধরে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।’’ তাঁর দাবি, অতিষ্ঠ হয়ে গত বছর হস্টেল সুপারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ‘‘তার পর থেকে মদের বোতল ছোড়া অন্তত বন্ধ হয়েছে। ছাত্র-মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দিলে আশা করি এ সব বন্ধ হবে’’— বলছেন তিনি। ওই আবাসনের এক মহিলা বাসিন্দা বললেন, ‘‘ওঁদের অসভ্যতার কারণে মেয়েরা ছাদে উঠতে পারেন না। জানলা বন্ধ রাখতে হয়।’’ আর এক মহিলার দাবি, ‘‘ছাত্র-মৃত্যুর পরেও কয়েক জনকে হস্টেলের ছাদে নেশা করতে দেখেছি। তবে গাঁজা না সিগারেট, তা জানি না।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, মাঝেমধ্যেই হস্টেল নিয়ে অভিযোগ এসেছে। কিন্তু ভিতরে ঢোকার অনুমতি না থাকায় পুলিশ অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তা হস্টেল সুপার বা রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠাত। তার পরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, তা নিয়ে পুলিশকে জানানো হত না। তবে পড়ুয়ার মৃত্যুর তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, ওই হস্টেলের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ডিন পুলিশকে জানিয়েছেন, হস্টেলে আইনের শাসন নেই। উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সেখানে।

তবে সেই উচ্ছৃঙ্খলতা যাতে সীমা লঙ্ঘন না করে, সে দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কথাই বলছেন যাদবপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায়। তাঁর কথায়, ‘‘সব হস্টেলেই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র থাকে। সেখানে মজা করা, বন্ধুবান্ধব মিলে আনন্দ করার ঘটনা তো ঘটেই। কিন্তু দেখতে হবে, মজা বা আনন্দ যেন সীমা অতিক্রম না করে যায়। সেই আনন্দ যেন আশপাশের বাসিন্দাদের নিরানন্দের কারণ না হয়।’’ আর তর্পণ বলছেন, ‘‘অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটলে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যাদবপুরের পড়ুয়ারা যে ভাবে আন্দোলনে নেমেছে, তা নজিরবিহীন। এ দিক থেকে যাদবপুর ব্যতিক্রমী। ভবিষ্যতে এখানে র‌্যাগিংয়ের ঘটনা আর ঘটবে না বলেই আশা করি।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.