ওএমআর পুনর্মূল্যায়ন? না ফের পরীক্ষা? এসএসসির পুনর্নিয়োগ নিয়ে ঠিক কী রয়েছে হাই কোর্টের রায়ে?

এসএসসির চাকরি ফিরে পেতে প্রত্যেক চাকরিহারাকেই নতুন করে পরীক্ষায় বসতে হবে? না কি ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমেই পূরণ করা হবে হাই কোর্টের নির্দেশে খালি হওয়া এসএসসির শূন্যপদগুলি? সোমবারের রায়ের পরে এই নিয়েই শুরু হয়েছে নানা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং জল্পনা।

মামলার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীদের একাংশের মতে, এসএসসির গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি এবং নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক পদে সব চাকরিহারাকেই আবার পরীক্ষায় বসতে হবে। অর্থাৎ, তেমনটা হলে নতুন করে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে থেকে পরীক্ষা, ইন্টারভিউ-সহ সব পদ্ধতি মেনেই নতুন করে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়া। যদিও এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে আইনজীবীদের একাংশের।

সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের এসএসসির সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়েছে। ২৮২ পাতার ওই রায়ে শিক্ষক পদের পাশাপাশি গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি মিলিয়ে বাতিল হয়েছে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি। রায় ঘোষণা করে দুই বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এসএসসিকে। ঘোষিত শূন্যপদের প্রেক্ষিতে নিয়োগ হবে।

নিয়োগের জন্য নতুন করে আয়োজন, মূল্যায়ন এবং ওএমআর শিট স্ক্যান করতে হবে। এর জন্য ওপেন টেন্ডার করতে হবে। টেন্ডারের জন্য মানদণ্ড কোন শর্তসাপেক্ষে হবে তা-ও ঘোষণা করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির বেঞ্চ।

নিয়ম মেনে এসএসসি-কে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যকর করার জন্য হাই কোর্ট নির্দেশ দিলেও সেই ‘নিয়মের’ ব্যাখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে আইনজীবীদের মধ্যে। একাংশের মতে হাই কোর্টের নির্দেশে স্পষ্ট, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ-সহ পুরনো নিয়োগ প্রক্রিয়াই নতুন করে করতে হবে। অন্য পক্ষের মতে, ২৮২ পাতার কোথাও গোটা প্রক্রিয়া নতুন করে আয়োজনের কথা বলা নেই।

তবে সেই সঙ্গেই তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন, ওএমআর শিট বা উত্তরপত্রের আসল কপি বা ‘মিরর ইমেজ’ পাওয়া না-গেলে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রসঙ্গত, সোমবার রায় ঘোষণা করতে গিয়ে হাই কোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ যে ১৭ দফা দুর্নীতির কথা বলেছিল, তার অন্যতম অংশ হল, এসএসসির তরফে ইচ্ছাকৃত ভাবে ওএমআর শিটের আসল কপি নষ্ট করে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে ওএমআর শিটের ‘মিরর ইমেজ’ এসএসসির সার্ভারে সংরক্ষিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এসএসসির সার্ভার থেকে ওই ধরনের কোনও ‘মিরর ইমেজ’ খুঁজে পায়নি।

সিবিআইয়ের দাবি, ওএমআর শিট স্ক্যান করে তার ‘মিরর ইমেজ’ সংরক্ষণ না করেই আসল কপি নষ্ট করেছে এসএসসি। এসএসসি আবার তথ্য জানার অধিকার আইনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আবেদনকারীদের স্ক্যানড ওএমআর শিট দেখায়। এসএসসি জানায়, তাদের ডেটাবেস থেকেই ওগুলি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিবিআই এসএসসির সার্ভার থেকে কিছুই পায়নি। এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনেক ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে। যেগুলি এখনও আপলোড করা হয়নি, সেগুলি দ্রুত আপলোড করার নির্দেশও সোমবার দিয়েছে হাই কোর্ট।

মূল মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মঙ্গলবার বলেন, ‘‘পুরনো আসল ওএমআর বা তার মিরর কপি যেটা সিবিআই বাজেয়াপ্ত করেছে, সেটা আপলোড করলে যদি কোনও বিতর্ক না থাকে, তা হলে সেই আপলোডেড ওএমআরের ভিত্তিতে নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ওই পুনর্মূল্যায়নের কাজ করার জন্য নতুন করে পুনর্মূল্যায়নকারীদের নিয়োগ করতে হবে। পুনর্মূল্যায়নের পর যদি দেখা যায়, যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন আগে, তাঁরা আবার নম্বরের ভিত্তিতে চাকরি পাচ্ছেন, তবে তাঁদের চাকরি বহাল থাকবে। তা না হলে বাতিল হবে। নতুন করে পরীক্ষার অবকাশ থাকবে না।’’ কিন্তু সেই সঙ্গেই বিকাশ মনে করিয়ে দিয়েছেন, পুনর্মূল্যায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন আপলোড করা ওএমআর শিট নিয়ে কোনও রকম বিতর্ক থাকবে না।

বিতর্কিত চাকরিপ্রাপকদের আইনজীবী অনিন্দ্য লাহিড়ি অবশ্য দাবি করেছেন, ওএমআর পুনর্মূল্যায়ন নয়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই নতুন ভাবে করার কথা বলা হয়েছে হাই কোর্টের নির্দেশে। তিনি বলেন, ‘‘এসএসসি মামলায় সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে কোথাও বলা হয়নি, ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। এ বিষয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানো হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা হল, প্রথম থেকে ‘সিলেকশন’ (চাকরিপ্রাপক নির্বাচন) প্রক্রিয়া হবে বলা হয়েছে। নতুন করে চাকরিপ্রাপক নির্বাচন মানে নতুন করে বিজ্ঞাপন। তাতে আজকের যাঁরা চাকরিপ্রার্থী, তাঁরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পাশাপাশি, নতুন প্রক্রিয়ায় ওএমআর মূল্যায়নকারী টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেছে নিতে হবে। কী কী যোগ্যতা থাকলে ওএমআর মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া যাবে, সেটিও এসএসসি-কে ওয়েবসাইটে দিতে হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘সব কিছু শূন্য থেকে শুরু করার কথা বলা হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে।’’

হাই কোর্টের রায়ে চাকরিহারাদের একাংশ মঙ্গলবার থেকেই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। তাঁদের প্রশ্ন, কিছু অযোগ্য চাকরিপ্রাপকের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ যোগ্যরা কেন বঞ্চিত হবেন? অযোগ্যদের জন্য কেন সমাজ তাঁদের অপরাধী হিসাবে দেখবে? বিজ্ঞপ্তি জারি করে নতুন করে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে আগামী দিনে সেই বিতর্ক আরও জোরালো হবে বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.