নিয়োগ হয়নি দীর্ঘদিন, বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও সীমিত। ভোট বা পুজো এলেই বোঝা যায় টেনেটুনে কাজ চালানোর কষ্ট। অথচ, অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে এ বার কলকাতা পুলিশকেই সামলাতে হবে আয়তনে প্রায় কলকাতা পুলিশ এলাকারই সমান ভাঙড়! কী করে হবে? কাকে দিয়ে হবে?— কলকাতা এবং রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ভাঙড়কে কলকাতা পুলিশের অধীনে আনতে চান, এমনটা জানাজানি হতে এই চর্চা চলছে। বাহিনীর অন্দরে চিন্তার স্রোত বইছে। পদস্থ কর্তারা ভাবছেন, কী করে লালবাজারে বসে এত দূরের এলাকা সামাল দেবেন? নিচুতলার কর্মীরা ভাবছেন, কাকে, কখন বদলি করে ভাঙড়ে পাঠানো হবে? মুখে যদিও সব পক্ষের মত, ‘‘আপাতত সবই তো কথাবার্তার পর্যায়ে। আগে কাগজে-কলমে সিদ্ধান্ত হোক।’’
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার সকালে ভাঙড় এবং কাশীপুর থানা-সহ ভাঙড়ের দু’টি ব্লকের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে কলকাতা পুলিশের পূর্ব ডিভিশনের উপ নগরপাল আরিশ বিলালের নেতৃত্বে একটি দল। সঙ্গে ছিলেন বারুইপুর জেলা পুলিশের আধিকারিকেরা। গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখার অতিরিক্ত কমিশনার সুজিত চক্রবর্তীও। ওই এলাকা গ্রামীণ জনপদ হওয়ায় অপরাধের ধরন আলাদা। গোয়েন্দারা ভাঙড় এবং কাশীপুর থানার অফিসারদের কাছে সে সম্পর্কে জানতে চান। সূত্রের খবর, থানা ভবন এবং পুলিশ ডিভিশনের অফিস নিয়ে স্থানীয় বিডিও-র সঙ্গেও কথা বলেন বিলাল।
পুলিশ সূত্রের খবর, ভাঙড়ের জন্য অন্তত সাতটি থানা তৈরির ভাবনা চলছে। ভাঙড়ের কেএলসি থানা কলকাতা পুলিশের অধীনেই। সেটি ভেঙে দু’টি থানা তৈরি করা হতে পারে। সেই সঙ্গে ভাঙড় থানা ভেঙে তিনটি এবং কাশীপুর থানা ভেঙে দু’টি থানা হতে পারে। সব মিলিয়ে সাতটি থানা নিয়ে নতুন ডিভিশন তৈরি করা হতে পারে বলে খবর। মূল সমস্যা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা। পুলিশ সূত্রের খবর, বাহিনীতে এই মুহূর্তে প্রায় ১০ হাজার কর্মীর ঘাটতি রয়েছে। তাই নিয়ে কোনও মতে কলকাতা পুলিশের ৩১১ বর্গকিলোমিটার এলাকা সামলানো হচ্ছে।
সেখানে ভাঙড়ের দু’টি ব্লক মিলিয়েই আয়তন প্রায় ২৭৩ বর্গকিলোমিটার। এই বিপুল এলাকা ওই বাহিনী নিয়ে সামলানো যাবে কী করে? পুলিশকর্তাদের বড় অংশের বক্তব্য, এতে লালবাজার তার গৌরব যেমন হারাতে পারে, তেমনই প্রয়োজনে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত বাহিনী পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে মার খেতে পারে। ফলে ভাঙড়কে কলকাতা পুলিশের আওতায় আনার ভাবনাই কার্যক্ষেত্রে ধাক্কা খেতে পারে।
এই প্রেক্ষিতেই বাহিনীর একাংশ আবার জানাচ্ছেন, নতুন করে ৩৩০ জনের মতো সাব-ইনস্পেক্টর নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া বাকি। কনস্টেবল পদে নিয়োগ হবেন ২২৬৬ জন। যাঁদের প্রাথমিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। চলতি বছরের শেষে তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারেন। এ ছাড়া, চলতি সপ্তাহে রাজ্য আরও ২৫০০ জনকে কলকাতা পুলিশে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে। তবে সেই প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি এবং প্রয়োজনের থেকে এই সংখ্যা কম বলেও বাহিনীর অন্দরে অভিযোগ।
জানা যাচ্ছে, রাজ্য পুলিশের তরফে আগেই ভাঙড় থানা ভেঙে চন্দনেশ্বর এবং ভাঙড় ও কাশীপুর থানা ভেঙে পোলেরহাট এবং কাশীপুর থানা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। এ সবের মধ্যে তাই প্রশ্ন উঠছে, ওই প্রস্তাব কার্যকর হলে কি পঞ্চায়েত নির্বাচনের অশান্তি এড়ানো যেত? তা হলে কি ভাঙড়ের এই বাড়তি চাপ কলকাতা পুলিশের ঘাড়ে পড়ত না?
এ দিকে, ভাঙড়কে কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত করার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের প্রশ্ন, ভাঙড়ের একাংশ কলকাতা পুলিশের অধীনেই ছিল। তার পরেও কি হিংসা কমেছে? তাঁদের আরও প্রশ্ন, এক দিকে মুখ্যমন্ত্রী ভাঙড়কে কলকাতা পুলিশে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন, অন্য দিকে হিংসায় অভিযুক্ত শওকত মোল্লা, হাকিবুল ইসলামদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। যদিও তৃণমূলের যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রী ভাঙড়ে শান্তি ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছেন।
আইএসএফ চেয়ারম্যান তথা ভাঙড়ের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকীর দাবি, তিনি যেখানে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, সেই জায়গা কলকাতা পুলিশের অধীনে ছিল। নওসাদ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে ভাঙড়বাসীর যদি ভাল হয়, তা হলে স্বাগত। কিন্তু যদি পুলিশ দিয়ে এই বিধানসভা উদ্ধারের চেষ্টা হয়, তা হলে বিধায়ক হিসেবে চুপ করে থাকব না।’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘ভাঙড়ের কিছু এলাকা তো আগেই কলকাতা পুলিশের অধীনে ছিল। তাতে কি হিংসা কমেছে? মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা পুলিশের এলাকা বাড়াচ্ছেন, আবার শওকত, আরাবুলদের মাথায় হাত রাখছেন।’’
তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লার দাবি, ‘‘ভাঙড়কে অশান্ত করেছে আইএসএফ ও বিরোধীরা। বরং মুখ্যমন্ত্রীর চেষ্টায় ভাঙড়ে শান্তি ফেরাতে সুবিধা হবে।’’