নেমেছিলাম ‘প্রাচী’ সিনেমার সামনে। রাস্তাটা তার পরেই শিয়ালদহ উড়ালপুলে উঠে গিয়েছে। বাস থেকে নেমেই উড়ালপুলের কান ঘেঁষে দৌড়। রাত ১১টার বনগাঁ লোকাল শিয়ালদহ থেকেই ছাড়বে। দিনের শেষ ট্রেনও তা-ই। সেটা যদিও রাত ১১টা ৫০ মিনিটে। দু’মিনিটের মাথায় যখন স্টেশনে পৌঁছলাম, ঝুলতে থাকা ডিজিটাল ঘড়ির লাল ডিজিটে তখন ১০টা ৫৪। পাশেই ডিজিটাল ‘ডিসপ্লে বোর্ড’। সেখানেও লাল ডিজিটে লেখা একের পর এক গন্তব্যের নাম। পাশে সময় সারণি। যে সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।
এমনিতেই শিয়ালদহ স্টেশনটা দেখতে মোটা দাঁড়ের চিরুনির মতো। লাইনের অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকিটা জুড়ে আজ শুধুই মানুষের সারি। অন্য দিনেও এই একই সময়ে শিয়ালদহ থেকে ১১টার বনগাঁ লোকাল ধরি। কখনও কখনও শেষ ট্রেন। স্টেশনে ভিড় থাকে বটে, তবে তেমন কিছু নয়। এ যেন ম্যাডস্ক স্কোয়ারে দুর্গা-অষ্টমীর সন্ধ্যার ভিড়! পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম একেবারেই নীরব। বোর্ড দেখে বুঝলাম, ১০টা ১৫ মিনিটের হাসনাবাদ লোকাল তখনও ছাড়েনি । ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ৯ নম্বরে দাঁড়িয়ে ১০টা ৩৪ মিনিটের বনগাঁ লোকাল। এ ছাড়া শান্তিপুর থেকে রানাঘাট— সবই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনের সারিতে একটা এক্সপ্রেস ট্রেনও রয়েছে— ‘পদাতিক’। ১১টা ২০ মিনিটে ছাড়বে। ১ থেকে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকটায় কাজ চলছে। নানাবিধ আওয়াজ আসছে ওই দিকটা থেকে। তার মধ্যেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহযাত্রী কোথায় যাব শোনার পর পরামর্শ দিলেন, ‘‘৯ নম্বরে তো দাঁড়িয়ে রয়েছে আগের ট্রেন। ওটা ধরে নিন। পরেরটা কখন পাবেন, আদৌ ছাড়বে কি না এখান থেকে তা কে জানে!’’
ট্রেন কখন ছাড়বে? সত্যিই তো কোনও ঘোষণা নেই। কোনও মতে ভিড় ঠেলে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোনো গেল। তত ক্ষণে ১১টা ১০ বেজে গিয়েছে। বনগাঁ লোকালের গার্ড (ট্রেন ম্যানেজার) সাহেবের কেবিন ফাঁকা। ট্রেনের ডিসপ্লে-ও পাল্টানো হয়নি। গন্তব্যের জায়গায় তখনও জ্বলজ্বল করছে ‘শিয়ালদহ’। ভিড়কে পাশ কাটিয়ে কোনও রকমে পৌঁছনো গেল একেবারে সামনের দিকে। চালকের কেবিনও ফাঁকা। সামনেও ডিসপ্লেতে হলুদ রঙে লেখা ‘শিয়ালদহ’। ট্রেনের সামনে একটা বিপুল জটলা। কখন ছাড়বে তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সিগন্যালও লাল। ওই ভিড় থেকেই উঠে আসছিল রেলের প্রতি নানা ‘বাণী’।
১০ নম্বরের হাসনাবাদ লোকালও ভিড়ে টইটম্বুর। আচমকাই সওয়া ১১টা নাগাদ নীরবতা কাটিয়ে ঘোষণা করা হল, ‘‘১০ নম্বরের হাসনাবাদ লোকাল পরে ছাড়বে। ৯ নম্বরের বনগাঁ লোকাল আগে ছেড়ে যাবে।’’ পাশের হাসনাবাদের ভিড়টা ঝর্নার মতো নেমে এল বনগাঁ লোকালের ভিতরে। ওই ভিড়েই গা ভাসিয়ে কোনওমতে উঠে পড়লাম। বাঙ্কারে ব্যাগ রাখার জায়গাটুকু নেই। নীচে নেই পা রাখার জায়গাও। প্রায় ১১টা ২০ মিনিট নাগাদ হর্ন বাজিয়ে ছেড়ে দিল বনগাঁ লোকাল। প্ল্যাটফর্মের অংশটুকু পেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিড়ে বুজে আসা জানলার ফাঁকফোকর গলে তাকালাম। হ্যালোজেন আলোয় ভেসে যাচ্ছে বাইরেটা। কাজ চলছে। কী যে কাজ তা বোঝা দুঃসাধ্য। প্রচুর লোক। প্রচুর যন্ত্রপাতি। আর নানাবিধ শব্দ। সে সব শব্দ যদিও সহযাত্রীদের কথোপকথনের আওয়াজে ঢাকা পড়ে যাওয়ার জোগাড়। রেল বলেছিল, এই সময়ে সব ১২ কামরার ট্রেন চালানো হবে। কিন্তু, এই বনগাঁ লোকালটা ৯ কামরার! কথা রাখেনি রেল।
বেলার দিকে অফিস আসার সময় যে ট্রেন ধরেছিলাম, সেটি দমদম ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত এসেছিল। সেখানে নেমে অটো, টোটো, মেট্রো পেরিয়ে শেষমেশ চাঁদনি চকের অফিসে পৌঁছনো গেছিল ঘণ্টাখানেক দেরিতে। আসার পথে একমাত্র মধ্যমগ্রাম ছাড়া অন্য কোনও স্টেশনে কোনও ঘোষণাই শুনিনি। অথচ রেলের তরফে বার বার দাবি করা হয়েছে, যাত্রীদের জানানোর জন্য যা যা করার, তা তারা করেছে। কিন্তু সে সব রেল-বার্তা যে সাধারণ যাত্রীদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছয়নি, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল দিনের শুরুতে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহযাত্রী প্রশ্নটা করলেন আচমকাই— ‘‘এত ভিড় কেন বলুন তো আজ?’’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কোথায় থাকেন?’’ আলাপচারিতায় জানতে পারলাম, ভদ্রলোকের নাম অজয় বসু। রাজ্য সরকারি কর্মচারী অজয় কর্মসূত্রে তমলুকে থাকেন। বাড়ি বারাসতে। শুক্রবার অফিস করে বাড়ি ফেরেন। আবার সোমবারে কর্মস্থলে যান। শিয়ালদহে যে ‘কর্মযজ্ঞ’ হচ্ছে তা তিনি জানতেনই না। ভদ্রলোককে জানানো গেল, মেন লাইনের শেষ ট্রেন দমদম জংশন থেকে ছাড়বে। বনগাঁ লোকাল তা-ও শিয়ালদহ থেকেই ছাড়ছে। সবটা শোনার পর বললেন, ‘‘ভাগ্য ভাল তো আমার। আর একটু হলে তো রাত কাটাতে হত শিয়ালদহে!’’
আমাদের আলোচনাতে জুড়ে গেলেন আর এক জন। ঠাকুরনগরের শ্রীদাম বালা। ভবানীপুরের একটি লেদে কাজ করেন। বলছিলেন, “সকালে যে ট্রেনে এসেছিলাম সেটা শিয়ালদা অবধি এসেছিল। জানতামই না ট্রেনের গন্ডগোল। রাতে শিয়ালদায় এত ভিড় দেখে একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সব ট্রেন চলছে না। কোথাও কোনও ঘোষণাও নেই। পয়সা দিয়ে মান্থলি কাটি। রেল কি আমাদের মানুষ ভাবে না!”
কোনও মতে বিধাননগর পেরিয়ে ট্রেন ভিড়ে ঠাসা দমদম স্টেশনে থামতেই ঠেলাঠেলি বেড়ে গেল। চাপটা বেশ টের পেলাম। বাইরে অনেকে ঝুলছেন। ট্রেন ছেড়ে দিল। মাথায় দপদপ করতে লাগল দুশ্চিন্তাটা! দুপুরেই তো এক যুবক এমনই এক ভিড় ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। আর তাঁর বাড়ি ফেরা হয়নি!
বাগজোলা খাল পেরিয়ে ট্রেন এগিয়ে চলে দমদম ক্যান্টনমেন্টের দিকে।