হিন্দু সমাজ কে ভক্তির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করার প্রথম সফল প্রয়াস করেছিলেন রামানুজাচার্য

রামানুজাচার্য (১০১৭–১১৩৭ সাল) দক্ষিণ ভারতের একজন প্রধান বৈষ্ণব ধর্মগুরু, যিনি বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। তাঁর জীবনের সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছিল।

রামানুজাচার্যের সময় ভারত ছিল বহু রাজ্য ও সাম্রাজ্যের দ্বারা বিভক্ত। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করছিল। দক্ষিণ ভারতে ছিল চোল, চের, ও পাণ্ড্য রাজবংশের আধিপত্য, আর উত্তর ভারতে গুর্জর-প্রতিহার, পাল, সেন ও পরবর্তী কালে দিল্লি অঞ্চলে তুর্কি আক্রমণ ও গজনির মাহমুদের আগমন।

চোল সাম্রাজ্য এই সময়ে দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশ। রাজরাজ চোল (৯৮৫–১০১৪) ও তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোল (১০১৪–১০৪৪) ভারতের দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে চোল প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁরা তামিল সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ও বৈষ্ণব মতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রামানুজাচার্যের কর্মকেন্দ্র ছিল চোল শাসিত অঞ্চল, বিশেষ করে শ্রীরঙ্গম ও কাঞ্চী। যদিও কিছু চোল শাসক শৈব মতের অনুসারী ছিলেন এবং রামানুজাচার্যকে দমন করতে চেয়েছিলেন, তবুও তাঁর দর্শন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
উত্তর ভারতে এই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। গজনির মাহমুদ (৯৭১–১০৩০) বারবার ভারত আক্রমণ করে এবং সোমনাথ মন্দিরের মতো অনেক হিন্দু ধর্মস্থল লুট করে। এই মুসলিম আক্রমণ ভারতীয় সমাজে এক ধরনের প্রতিরোধ এবং আত্মসংরক্ষার বোধ সৃষ্টি করে, যা আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণের পথ তৈরি করে। এই পটভূমিতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা ঘটে, যার অগ্রদূত ছিলেন রামানুজাচার্য।

এই সময় থেকে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ উপাসনার প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। পাল ও বৌদ্ধ পৃষ্ঠপোষক রাজাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ উপাসনা ধীরে ধীরে দেশের বাইরে, বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে প্রসারিত হয়। একইভাবে, জৈন উপাসনারও গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়, যদিও দক্ষিণ ভারতে জৈন মত তখনও টিকে ছিল।
রামানুজাচার্য হিন্দুধর্মে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তিনি বৈষ্ণব ধর্মে আত্মসমর্পণ, প্রেম এবং ভক্তিকে প্রধান স্থানে নিয়ে আসেন। তাঁর দর্শন ‘বিশিষ্টাদ্বৈত’ হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হয়ে ওঠে। এই দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
জীব (আত্মা), জগৎ ও ঈশ্বর — এই তিনটি অনাদি ও চিরন্তন, তবে ঈশ্বর সর্বোচ্চ।
জীব ঈশ্বরের অংশ, কিন্তু তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নয়।
মোক্ষ মানে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন নয় — এটি শঙ্করের অদ্বৈতের বিরুদ্ধ ভাবনা।
ভক্তি ও প্রপত্তি (আত্মসমর্পণ) হলো মোক্ষের পথ।
ঈশ্বর (নারায়ণ) গুণসম্পন্ন, সর্বগুণনিধান, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, এবং তিনি একমাত্র উপাস্য।
এই মতবাদে ভগবানের ব্যক্তিত্ব এবং ভক্তির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শঙ্করাচার্যের নিরাকার ব্রহ্মের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ঈশ্বর সব কিছু পরিব্যাপ্ত করেও ব্যক্তিসত্তায় বিদ্যমান থাকেন।
রামানুজাচার্যের সময় ভারতীয় সমাজ ছিল কঠোর বর্ণাশ্রম ধর্মের নিয়মে আবদ্ধ।রামানুজাচার্য বিশ্বাস করতেন, ভগবানের কাছে জাত বা বর্ণ নয়, ভক্তিই মুখ্য। তিনি নিম্নবর্ণের মানুষদের ভগবদ্ভক্তির অধিকার দেন, যা হিন্দু ধর্মের সমাজ সংস্কারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
রামানুজাচার্যের অন্যতম বৈপ্লবিক ভূমিকা ছিল সমাজে অন্ত্যজদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভগবানের কাছে সকল মানুষ সমান । তিনি তথাকথিত বহু নিম্নবর্ণের ব্যক্তিকে মন্দির সেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেন এবং তাঁদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীতে হিন্দু সমাজে ধীরে ধীরে সমন্বয়মূলক পরিবর্তন আনে।
রামানুজাচার্যের সময়ে মঠ ও মন্দির ছিল জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। সংস্কৃত ভাষা ছিল ধর্মীয় ও দর্শনচর্চার ভাষা। কিন্তু রামানুজাচার্য তামিল ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করে স্থানীয় ভাষায় ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর চিন্তাভাবনার ভিত্তি ছিল ‘আলবার’ সাধকদের তামিল ভাষায় লেখা দেবপ্রবন্ধম, যা সাধারণ মানুষের কাছে ভগবানের ভক্তিসূত্র উপস্থাপন করত।

তিনি অনেক মঠ স্থাপন করেন এবং একটি সুসংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন, যেখানে শিষ্যরা গুরু থেকে দর্শন ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করত। এই মঠগুলি পরবর্তীতে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
রামানুজাচার্যের দর্শন ও সমাজচিন্তা পরবর্তী যুগে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর অনুসারীরা দক্ষিণ ভারতের বাইরে, বিশেষত মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ও উত্তর ভারতের বৈষ্ণব সম্প্রদায়েও তাঁর ভাবধারা ছড়িয়ে দেন। তাঁর ভাবধারা শ্রীরামানন্দ, কবীর, মীরাবাই, তুলসীদাস প্রমুখ ভক্ত কবির চিন্তায় প্রতিফলিত হয়।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন পরবর্তীতে হিন্দু দর্শনের একটি মূলধারা হয়ে ওঠে এবং হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদী ভাবনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
রামানুজাচার্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হলো ‘শ্রীভাষ্য’, যা ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্রের উপর তাঁর লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
রামানুজাচার্যের সময় ভারতীয় ইতিহাস ছিল গভীর পরিবর্তনের একটি যুগ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় প্রতিযোগিতা, সামাজিক বিভাজন এবং সাংস্কৃতিক জটিলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রামানুজাচার্য এক নতুন আধ্যাত্মিক দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর দর্শন ও মানবতাবাদী চিন্তা ভারতীয় সমাজে একটি বৃহৎ প্রভাব ফেলেছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি শুধু একজন ধর্মগুরু নন, বরং ভারতীয় ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব যিনি ভক্তির মাধ্যমে হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার পথ দেখান।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.