রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত লাইন– ‘এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি’। নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ কাব্যিক এক্সপ্রেশন। এ ছাড়াও রেলপথ নিয়ে রয়েছে তাঁর এমন এক লাইন যা ভারতে রেলপথের প্রসারকে দ্যোতিত করতে ব্যবহৃত হয়– ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’! কিন্তু কবিতার কথা যদি-বা ছেড়েও দেওয়া যায়, তা হলেও রেলযাত্রা নিয়ে তাঁর কম লেখাপত্র, কম স্মৃতি নেই। তাঁর গোটা সাহিত্যকৃতি জুড়েই সেসব ফিরে-ফিরে এসেছে। ১১ বছর ৯ মাস বয়সে, ১৮৭৩ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম ট্রেনযাত্রা, মহর্ষির সঙ্গে। আর শেষ ট্রেনযাত্রা ছিল ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই। এই শেষ ট্রেনযাত্রার পরে আর মাত্র ১৪ দিন বেঁচেছিলেন তিনি। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে কবির দীর্ঘ জীবনের প্রথম ও শেষ রেলযাত্রা একই রুটে! সত্যিই, কবির জীবনের যাত্রা-পথ যেন এভাবেই এক সুরে বেঁধে দিল রেলের বন্ধনহীন গ্রন্থি!
রবিঠাকুর ও ভারতীয় রেলের সম্পর্ক বহুদিনের, বহুস্তরীয়। আর এই সম্পর্ককে বার বার শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে পূর্ব রেল। আজও তাঁরা কবির শেষযাত্রার মর্মবেদনাকে ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি তাদেরই ব্যবস্থাপনায় কবির ব্যবহারধন্য সেই সেলুনটির কথা। যেটি চেপে কবি সেদিন চিকিৎসা করাতে কলকাতা গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফেরা হয়নি তাঁর! কবির শেষ-যাত্রার স্মৃতিধন্য সেই রেলকামরাটি যথাযোগ্য সম্মানে ও মর্যাদায় আজও রাখা রয়েছে বোলপুর স্টেশন সংলগ্ন ‘চিরন্তনী’ রেল সংগ্রহশালায়। সেদিন কবি ব্যবহার করেছিলেন ‘ইআইআর ২৩৭৭’ কামরাটি। রেলের চিফ অপারেটিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিবারণচন্দ্র ঘোষ সেদিন এই সেলুনে কবির সঙ্গেই ছিলেন।
তবে শুধু যাত্রী হিসেবেই তো নয়, ভারতীয় রেলের সঙ্গে অন্যরকম একটা যোগাযোগও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের। সেটা একেবারেই পারিবারিক। ঐতিহাসিকও বলা চলে। তাঁর বিখ্যাত ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কোলিয়ারির ব্যবসা ছিল। ইংলন্ডে রেল দেখে এসে দ্বারকানাথ এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি চেয়েছিলেন অন্তত তাঁর কোলিয়ারি অঞ্চলে যাতে রেলপথ বসানো যায়। তা হলে মালবহনে সুবিধা হবে। এই মর্মে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পরানির সঙ্গে কথাবার্তাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, ব্রিটিশ কোম্পানি সেদিন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের দায়িত্ব কোনও ‘নেটিভ’কে দেবে না বলে দ্বারকানাথ সেদিন এই কাজের বরাত পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন। যদিও প্রায় সেই সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে রেলপথ তৈরির কথা তলায়-তলায় ভাবতেও শুরু করে দিয়েছিল!
একেই বোধ হয় বলে ‘ডেস্টিনি’। একটু হালকা করে ‘সমাপতন’ও কি বলা চলে না? যে-রেলপথ স্থাপন করার ব্যক্তি-গৌরব থেকে সেদিন শুধু ‘নেটিভ’ বলেই বঞ্চিত থাকতে হল প্রিন্স দ্বারকানাথকে, পরবর্তীকালে সেই ভারতীয় রেলপথই তাঁর পৌত্র ‘নেটিভ’ রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার সঙ্গে জুড়ে গিয়ে অর্জন করে নিল চিরকালের স্মরণমর্যাদা!