শুক্রবার বাংলা নববর্ষ। ১৪২৯ সাল। নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে আগের চেয়ে কম হলেও প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে উন্মাদনা রয়েছে। সেই বাংলা ক্যালন্ডারের ইতিহাসের প্রতিটি পরতে আছে রহস্য আর পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব। বর্তমান সময়ে এসে, ভোট আর ঘোট রাজনীতির পরম্পরায় রাতারাতি বাংলা ক্যালেন্ডারের ইতিহাস নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
আকবর নাকি শশাঙ্ক? কৃতিত্ব কার? আপনাকে ফিরে যেতে হবে মুঘল জমানায়, বা আর একটু পিছনে সেই শশাঙ্কের আমলে। কিন্তু কোন তত্ত্ব বাস্তবের কাছাকাছি বলে মনে হয়?
আকবর তত্ত্বের বক্তব্য হল, বাংলা জয় করার পর সম্রাট আকবর এক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন বঙ্গে। তারা তত্ত্ব তল্লাশ করে দেখলেন যে বাংলায় খাজনা আদায়ের জন্য নতুন একটি ক্যালন্ডার জলদি দরকার। ওঁদের মনে হয়েছিল, প্রচলিত ইসলামিক বা হিজরি ক্যালেন্ডার চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে প্রতি বছর খাজনা আদায়ের তারিখ এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। বলাই বাহুল্য, হিন্দু শকাব্দের সঙ্গে যুক্ত না করে মুসলিম হিজরির সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টা ছিল।
তবে এই তত্ত্বের বিরুদ্ধ মত হল, আকবর জীবদ্দশায় কোনও দিন বাংলা কব্জা করতে পারেননি। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে মুঘলরা প্রথমবার বাংলা জয় করলেও, সেই যুদ্ধ অনেক দিন ধরে চলেছিল। তাই রাতারাতি বাংলায় আকবর যে নতুন সাল শুরু করবেন আর সবাই মেনে নেবেন চুপিসারে সেটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। সাবেক বাংলাদেশে অবশ্য মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে এই নিয়ে কমিশন তৈরি হলে, রায়ের পাল্লা ভারী ছিল আকবর তত্ত্বের দিকেই।
বঙ্গাব্দের প্রবর্তক শশাঙ্ক, এই ধারণা মানতে গেলে ইতিহাসের পাতায় ফিরতে হবে ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে। ঘুরে আসতে হবে আজকের বহরমপুর শহরের কর্ণসুবর্ণতে। সেই সময়ে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে একজন সামন্ত রাজা। পরবর্তীকালে তিনি সার্বভৌম গৌড়ের শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বঙ্গভূমিতে। এই তত্ত্ব অনুসারে, ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক মারা যাওয়ার ৪৫ বছর আগে বঙ্গাব্দ চালু হয়। অঙ্কের দিক থেকে, বঙ্গাব্দের সঙ্গে ইংরেজি সালের ব্যবধানও ঠিক ৫৯৩ সালের। নতুন বছরে, অর্থাৎ ১৪২৯ সালের সঙ্গে ইংরেজি ২০২২ সালের ব্যবধানও ৫৯৩ বছরের। তবে এই তত্ত্বের সমালোচকরা বলেন যে ওঁর আমলে বাংলা ভাষা চালুই হয়নি। তাই বাংলার জন্য আলাদা সন চালু হওয়া বাড়াবাড়ি ভাবনাচিন্তা।
অমর্ত্য সেনের মতো অনেকে আবার বলেন, দীন ই ইলাহির মতো ক্যালন্ডারের দিক থেকে সমগ্র ভারতের জন্য তারিখ-ইলাহি অর্থাৎ ‘এক দেশ-এক ক্যালেন্ডার’ চালু রাখার চেষ্টা করেছিলেন আকবর, তা একমাত্র টিমটিম করে জ্বলছে স্রেফ দুই বাংলায়!
এই নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তবে সেই গবেষণায় আবার রাজনৈতিক বা ভোটের অনুপ্রেরণা থাকলে মুশকিল। তাই বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি জানা থাক বা না থাক, উৎসব উদ্যাপন চলছে, চলবে!