তিনি ফোন ধরেই বলেন ‘জয়গুরু’, দেখা হলেও তাই। বিদায় দেওয়ার সময়ও বলেন ‘জয়গুরু’! আর তাঁর জীবন ঘিরে যখন ‘বায়োপিক’ হতে চলেছে, তার নামটিও সেই ‘জয়গুরু’ই। তিনি পার্বতী বাউল!
বাউল সঙ্গীত ও দর্শনকে আন্তর্জাতিক স্তরে যে সমস্ত শিল্পীরা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার মধ্যে পার্বতী বাউল অন্যতম। এ বার তাঁরই জীবনের আধারে তৈরি হচ্ছে একটি হিন্দি ছবি। ছবির নাম ‘জয়গুরু’। ছবিটি পরিচালনা করবেন টলিপাড়ার অভিনেতা ও পরিচালক সৌম্যজিৎ মজুমদার।
সম্প্রতি, নিউ ইয়র্কের টাইমস্ স্কোয়ারে তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনের পর পার্বতী নিজের মুখে এই ছবির কথা ঘোষণা করেছেন। সৌম্যজিৎ অভিনেতা হিসাবে টলিপাড়ার পরিচিত মুখ। এর আগে তিনি ‘হোমকামিং’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। হঠাৎ তিনি পার্বতী বাউলের জীবনকে কেন্দ্র করে ছবি তৈরি করছেন কেন?
এই মুহূর্তে সৌম্যজিৎ আমেরিকায়। সেখান থেকেই ফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের পর থেকেই আমার ইচ্ছেটা প্রবল হয়। তার পর গত এক বছর ধরে ওঁর আশ্রমে যাতায়াত শুরু করি। চিত্রনাট্য তৈরি করি।’’ পার্বতীর মতো শিল্পী তাঁকে এই কাজে অনুমতি দিয়েছেন বলেও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না সৌম্যজিৎ।
এই ছবির কাঠামো নিয়ে এখনই খুব একটা খোলসা করতে রাজি নন পরিচালক। তবে সৌম্যজিৎ জানালেন, গল্পে একজন বাউল শিল্পীর (রাধিকা) সঙ্গে মুম্বইয়ের এক জন সঙ্গীত পরিচালকের (ঋত্বিক) সম্পর্ককে ধরে এগিয়ে যাবে গল্প। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতেই বাউল শিল্পীর মুখে তাঁর অতীত জীবনের কাহিনি উঠে আসবে। সৌম্যজিতের কথায়, ‘‘এক সময় হঠাৎই শিল্পী নিরুদ্দেশ হন। কেন? তার উত্তর রয়েছে ছবিতে।’’
পার্বতীর জীবন সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা হলেও জানেন, স্বভাবতই তাঁদের কাছে নানা কৌতূহল কিন্তু ভিড় করে আসতে বাধ্য, এই খবরটি পাওয়ার পর থেকেই। কোচবিহারের মৌসুমী পাড়িয়াল, সুনীতি অ্যাকাডেমির কিশোরী ছাত্রীর এক দিন ট্রেনে চেপে শান্তিনিকেতনে পাড়ি দেওয়া, অন্ধ বাউলের গান শুনে সে গানের ভক্ত হওয়া, তার পর একে একে গুরু-মা ফুলমালা দাসী, সনাতন দাস বাউল, শশাঙ্ক গোঁসাইয়ের সঙ্গ পাওয়া থেকে আজকের পার্বতী বাউলের হয়ে ওঠা, কতটা ধরাবে এই ‘বায়োপিক’! এর সঙ্গে তাঁর পরিবার আছে, তাঁর পরিজন আছে, তাঁর নানা দেশের নানা স্তরের মানুষজনের সঙ্গে মিলমিশ আছে, সবটা ধরাতে পারবে কি এই ছবি?
সব চেয়ে বড় কথা, পার্বতী মানে শুধু তো বাংলা নয়, গোটা পৃথিবী, আজ তিনি বোলপুরের কামারডাঙা গ্রামে এক মস্ত আশ্রম খুলে বসেছেন বটে, কিন্তু তার পাশাপাশি তাঁর দিনলিপি শুনলে চোখ কপালে ওঠে। এই লাটভিয়া তো, তো এই লক্ষদ্বীপ। তো, পর দিন লাস ভেগাস। পার্বতী শুধু তো বাউল-সাধক নন, তিনি আদ্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী, পশুপ্রেমী, মানবপ্রেমী। এই ব্যাপক বিস্তৃত জীবনকে পর্দায় ধরা বড় কঠিন কাজ। কিন্তু প্রাণপনে তাকেই কব্জা করতে চাইছেন পরিচালক।
ছবির চিত্রনাট্যের কাজ চলছে। আসন্ন কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি ‘ফিল্ম মার্কেট’য়েও জায়গা করে নিয়েছে। এই ছবি নিয়ে উচ্ছ্বসিত পার্বতী নিজে। তাঁর কথায়, ‘‘গত এক বছর ধরে সৌম্যজিৎ ছবিটি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। ওঁর পরিশ্রম আমাকে মুগ্ধ করেছে।’’
তবে তাঁর জীবনের পরিবর্তে বাউল দর্শনকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরাই যে ছবির অন্যতম লক্ষ্য, সে কথাও স্পষ্ট করেছেন পাবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘আমার মতে ছবির মাধ্যমে বাউল সংস্কৃতিকে আরও বেশি সংখ্যক দর্শকের সামনে তুলে ধরার এটাই সঠিক সময়।’’
এই ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে যোগ দিচ্ছেন রবি বর্মন। উল্লেখ্য, বলিউডে ‘বরফি’, ‘রামলীলা’, ‘তামাশা’র মতো ছবিতে ক্যামেরার দায়িত্ব সামলেছেন রবি। দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন অভিনীত ‘পোন্নিয়িন সেলভান’ও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
সৌম্যজিৎ বললেন, ‘‘বিজ্ঞাপনে অভিনয় করতে গিয়ে রবির সঙ্গে আমার আলাপ। কলকাতায় ‘তামাশা’র শুটিংয়ে পরিচালক ইমতিয়াজ় আলির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন রবিজিই। যোগাযোগটা রয়ে যায়। রবি আমার ছবিতে কাজ করতে রাজি হয়েছেন, এটা আমার কাছে বিশাল প্রাপ্তি।’’
পর্দায় পাবর্তীর চরিত্র এবং সঙ্গীত পরিচালকের চরিত্রটির জন্য মুম্বইয়ের একাধিক অভিনেতার সঙ্গে এর মধ্যেই কথাবার্তা শুরু হয়েছে বলে জানালেন পরিচালক। আগামী মাসে ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবেও তিনি উপস্থিত থাকার চেষ্টা করবেন বলে জানালেন সৌম্যজিৎ।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত (লোক আর্টস কালেক্টিভ), ইংল্যান্ড (মোরিঙ্গা স্টোডিয়োজ়), আমেরিকা (অ্যাডিটেড মোশন পিকচার্স) ও ফ্রান্সের (চয়ন সরকার) যৌথ প্রযোজনায় ‘জয়গুরু’ই প্রথম ছবি হতে চলেছে। আগামী বছরের শুরুতে ছবিটির শুটিং শুরু হবে। কলকাতা, শান্তিনিকেতন ছাড়াও লোকেশনের মধ্যে থাকছে বৃন্দাবন, কেরল, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্স।