বার বার তিন বার! মাত্র আড়াই বছরের কিছু বেশি সময় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা রয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। এই সময়কালের মধ্যেই স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বার সাসপেন্ড করেছেন তাঁকে। তবে এমন ঘন ঘন বহিষ্কারকে পাত্তা দিতে নারাজ নন্দীগ্রামের বিধায়ক। বরং রাজ্যের মানুষের অধিকারের দাবিতে সরব হয়ে আগামী দিনেও বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হতে রাজি বলে আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন তিনি।
শুভেন্দুর কথায়, ‘‘২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ২ কোটি ২৮ লক্ষের বেশি মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়ে বিরোধী আসনে বসিয়েছেন। আমি এবং আমার দল বাংলার মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। তাই এই ধরনের সাসপেনশনে আমাদের দমানো যাবে না। তিন বার কেন, ৩০০ বার সাসপেন্ড করে দেখতে পারেন ওঁরা!’’
বিধানসভায় শুভেন্দু প্রথম সাসপেন্ড হয়েছিলেন ২০২২ সালের মার্চ মাসের বাজেট অধিবেশনে। রাজ্যপালের ভাষণের দিন বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বিজেপি বিধায়কেরা। সেই বিক্ষোভের জেরে স্পিকার সাসপেন্ড করেন বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ ও মিহির গোস্বামীকে। সেই বছরই ২১ মার্চ বীরভুমের বগটুই গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের মহিলা ও শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে। সেই বিষয়ে সরব হয়ে বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি পরিষদীয় দল। বিক্ষোভের জেরে অধিবেশন কক্ষেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন বিজেপি এবং তৃণমূলের বিধায়কেরা। সেই ঘটনায় শুভেন্দু-সহ শঙ্কর ঘোষ, মনোজ টিগ্গা, দীপক বর্মন ও নরহরি মাহাতোকে সাসপেন্ড করেছিলেন স্পিকার। সেই সাসপেনশন প্রত্যাহারের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিজেপি বিধায়কেরা। আদালতের হস্তক্ষেপে অবশেষে তিনমাস পরে সাসপেনশন প্রত্যাহার করা হয়।
শুভেন্দু দ্বিতীয় বার সাসপেন্ড হয়েছিলেন ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে শীতকালীন অধিবেশনে। সে বার প্ল্যাকার্ড নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন বিজেপি বিধায়কেরা। যা নিয়ে বেজায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্পিকার। সেই প্ল্যাকার্ডে জেলবন্দি পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ছবি দেখিয়ে আক্রমণ করা হয় শাসকদলকে। বিজেপি বিক্ষোভ দেখালে পাল্টা বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল বিধায়কেরাও। সেই ঘটনা ঘটার সময় তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন স্পিকার ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। শেষমেশ শুভেন্দুকে সাসপেন্ড করা হয়। বাজেট অধিবেশন শুরুর সপ্তাহখানেক আগে অবশ্য স্পিকার জানান, শুভেন্দুর সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার। বিধানসভায় সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবৃতির দাবিতে সরব হয়েছিলেন বিজেপি বিধায়কেরা। পাল্টা বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল বিধায়কেরাও। একটা সময়ে বিক্ষোভ দেখাতে দেখাতে সভাকক্ষের ওয়েলে বসে পড়ে শুভেন্দুর নেতৃত্বাধীন বিজেপি পরিষদীয় দল। এর পরে তা নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় স্পিকার এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর। তখনই তৃণমূল পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষ গোটা বিজেপি পরিষদীয় দলকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবটি সংশোধন করে শুভেন্দু-সহ ছ’জন বিধায়ককে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব দেন পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে বিজেপি বিধায়কদের চলতি অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড ঘোষণা করে দেন স্পিকার।
গত বিধানসভা ভোটের পরে রাজ্যের রাজনীতিতে শুভেন্দুর উত্থান হয়েছে। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুর কলেজিয়েট মাঠে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন তৃণমূল সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রাম আসনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই ‘কঠিন যুদ্ধ’ জিতেছিলেন শুভেন্দু। তাঁকেই বিরোধী দলনেতা করে বিজেপি।
শুভেন্দুর প্রথম পরীক্ষা ছিল মমতার নেতৃত্বাধীন তৃতীয় সরকারের প্রথম বাজেট অধিবেশন। সেই অধিবেশনে শুভেন্দুর নেতৃত্বে বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের জেরে তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বাজেট ভাষণের প্রথম ও শেষ পাতা পড়েই বক্তৃতায় ইতি টেনেছিলেন। পিছিয়ে থাকেনি তৃণমূল পরিষদীয় দলও। তার পর থেকে অধিবেশনের নানা সময়ে শুভেন্দুকে উদ্দেশ্য করে ‘বাবাকে বলো’-র কর্মসূচি চালু করার খোঁচা দিতেন শাসকদলের মন্ত্রী-বিধায়কেরা। আবার ‘শিশিরবাবু (তৃণমূলের প্রবীণ নেতা শিশির অধিকারী) কোন দলে আছেন?’-এর মতো গঞ্জনাও শুনতে হয়েছে তাঁকে। তাতেও পিছিয়ে আসেননি শুভেন্দু।
এত বার বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হওয়ায় তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না?
শুভেন্দুর জবাব, ‘‘বগটুইয়ে যখন মুসলিম মহিলা ও শিশুদের আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল, তখন আমি সরব হয়েছিলাম বলে আমাকে প্রথম বার সাসপেন্ড করা হয়েছিল। আর এ বার যখন সন্দেশখালিতে তৃণমূলের দুষ্কৃতী নেতারা মা-বোনেদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তাঁদের অসম্মান করছে, তখন আবার আমি বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করে সরব হয়েছি। তাই আমায় সাসপেন্ড করা হয়েছে।’’ শুভেন্দু আরও বলেন, ‘‘রাজ্যবাসী দেখেছেন, আমি শোষিত মানুষের হয়ে বিধানসভায় কথা বলে তৃণমূলের মুখোশ খুলে দিয়েছি বলেই আমায় বার বার সাসপেন্ড করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা করে আমাকে থামানো যাবে না! অধিবেশনের ভিতরে কথা বলতে না দিলে বাইরে বলব!’’
শুভেন্দুর সঙ্গেই তিন বার বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষও। তাঁর কথায়, ‘‘যে রাজ্যে গণতন্ত্রই সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছে, সেখানে বিরোধী দলনেতা বা আমার সাসপেন্ড হওয়ার ঘটনা গৌণ বিষয়!’’