ছাত্রদের নয়, পরীক্ষা মাস্টারমশাইয়ের! বিরাটদের হেডস্যর পাশ করবেন? অপেক্ষা করতে হবে গম্ভীর মুখে

ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন প্যাডি আপটন।

ক্রিকেট, রাগবি, হকি মিলিয়ে ২০টির বেশি দল এবং শতাধিক পেশাদার খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করা এই স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ শিউরে উঠেছিলেন গৌতম গম্ভীরকে দেখে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ এবং পাকিস্তান সুপার লিগে কোচিং করানো আপটনের ‘দ্য বেয়ারফুট কোচ’ বইয়ের পাতা ওল্টালেই নির্ভয়ে লেখা সেই ভয়ের কথা জানা যাবে।

২০০৮ সাল থেকে তিন বছর আপটন ভারতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তৎকালীন কোচ গ্যারি কার্স্টেন নিয়ে এসেছিলেন তাঁকে। আপটনের মতে, তিনি যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক ভাবে সবচেয়ে নেতিবাচক এবং নৈরাশ্যবাদী লোকটির নাম গৌতম গম্ভীর। আপটন লিখেছেন, গম্ভীরের মতো এত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষ তিনি আগে দেখেননি। এখন আপটনের মতোই হয়তো অনেকেই ভয় পাচ্ছেন।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যাঁর হাতে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের সামলানোর ভার তুলে দিল, তাঁর সম্পর্কে ঠিক কী লিখেছিলেন আপটন? তাঁর কলমে, ‘‘গৌতম গম্ভীরের জন্য আমি নিজের সেরাটা দিয়েছিলাম। কিন্তু এত খারাপ রেজাল্ট কখনও পাইনি। ২০০৯ সালে আইসিসি-র বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের পুরস্কার পাওয়া সেই লোকটাকে নিয়েই সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে মানসিক ভাবে সবচেয়ে নেতিবাচক এবং নৈরাশ্যবাদী লোকটার নাম গৌতম গম্ভীর।’’ ভয়টা কি ক্রমশ বাড়বে?

কেন এমন মনে হয়েছিল, পঞ্চাশোর্ধ্ব ভদ্রলোক তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘‘নিরাপত্তাহীনতা, সন্দেহ— এগুলো সারা ক্ষণ ওর মধ্যে চেপে বসে থাকত। সব সময় একটা নড়বড়ে ভাব। এত নেতিবাচক লোক আমি আর দেখিনি। ও যাতে একটু পজিটিভ, একটু আশাবাদী হয়, তার জন্য নিজের যাবতীয় বিদ্যাবুদ্ধি প্রয়োগ করে সব রকম চেষ্টা করেছিলাম। এক বছরে টিম বাসে ওকে নিয়ে অন্তত ১৫ বার বসেছি। কোনও লাভ হয়নি। গম্ভীরকে বদলাতে পারিনি।’’

India cricket team's former strength and conditioning coach Paddy Upton

বদলাতে পারেননি বলেই দেশের হয়ে ৫৮টি টেস্ট, ১৪৭টি এক দিনের ম্যাচ এবং ৩৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার পরেও গম্ভীর নিজেকে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি। শুধু ভারতের অন্যতম সফল ওপেনার হিসাবেই থেকে গিয়েছেন।

গম্ভীরের গাম্ভীর্য বরাবরই চর্চার বিষয় হয়েছে। আপটনের মতো অনেকেই বলেছেন, ভাল খেলার জন্য সারা ক্ষণ হাঁকপাঁক করতেন গম্ভীর। কখনওই নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি। এই মানসিকতার ইতিবাচক দিক থাকলেও আপটন এটিকে নেতিবাচক হিসাবেই দেখেছেন। বইয়ে লিখেছেন, ‘‘অপটিমিজ‌়ম বা পেসিমিজ‌়ম-এর একটা স্কেল থাকে। গম্ভীরের স্কোর সব সময় নীচের দিকে থাকত। যেখানে একজন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে ৩০ স্কোরটা টায়েটুয়ে পাশ মার্ক, গম্ভীর মেরেকেটে ৪০-এ পৌঁছত। কখনও কখনও ওর স্কোর ২০-তে নেমে যেত। দেড়শো রান করলে ২০০ করতে না পারার জন্য মনখারাপ করে বসে থাকত। ওর জন্য যা-ই করতাম না কেন, ও সব সময় নেগেটিভ এবং পেসিমিস্টিক থাকত।’’

এর জবাবও দিয়েছিলেন গম্ভীর। বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, আমি শুধু চেয়েছিলাম নিজেকে এবং ভারতীয় দলকে বিশ্বসেরা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে। সেই কারণে সেঞ্চুরি করার পরেও খুশি হতে পারতাম না। আমি তো এর মধ্যে কোনও ভুল দেখছি না। আমি শুধু নিজের মানটা বাড়াতে চেয়েছি।’’ যে মানসিকতায় নিজেকে বিশ্বসেরা করতে গিয়েছিলেন গম্ভীর, আপটন সেটা দেখেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। সেই ভয়টাই আবার ফিরে আসবে না তো ভারতীয় ক্রিকেটে?

গম্ভীরের পদবি নিয়ে মিম, হাসাহাসি কম হয়নি। গত আইপিএলের সময়ই এক তরুণী ইডেন গার্ডেন্সে কেকেআরের ম্যাচ চলাকালীন মেন্টর গম্ভীরের কাছে একটি আবদার করেছিলেন। তিনি একটি পোস্টার নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, “আমি আমার ভালবাসার মানুষকে তখনই প্রেমের প্রস্তাব দেব, যখন দেখব গম্ভীর হাসছেন।” এই ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তরুণীর আবদার রেখেছিলেন গম্ভীর। তিনি নিজের ইনস্টাগ্রামে তরুণীর ছবি ও নিজের হাসিমুখের ছবি পাশাপাশি রেখেছিলেন। ক্যাপশনে লিখেছিলেন, “এই নাও।”

https://www.instagram.com/p/C6-qx1crwyp/embed/captioned/?cr=1&v=14&wp=549&rd=http%3A%2F%2Fmgmt-abp.ttef.in&rp=%2Fwp-admin%2Fadmin.php%3Fpage%3Dworkspace_create#%7B%22ci%22%3A0%2C%22os%22%3A815236.1999999881%7D

কেকেআরের মেন্টর হিসাবে ‘‘এই নাও’’ বলে পার পেয়ে গিয়েছিলেন গম্ভীর। কিন্তু ভারতীয় দলে অধিনায়কের মতোই কোচের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বক্তব্য, প্রতিটি পদক্ষেপ, চলাফেরা, হাসি, সমালোচনা— সব কিছু নিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাটাছেঁড়া চলবে। অজস্র মিম তৈরি হবে। টিটকিরি শুনতে হবে। এটুকু হলফ করে বলা যায়, কোচ হিসাবে গম্ভীরের নাম রজার বিন্নী, জয় শাহদের মাথায় মোটেই শুরু থেকে ছিল না। কেকেআর আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর রাতারাতি গম্ভীরের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রাজি করানো হয়েছিল। নাইট রাইডার্সের মালিক শাহরুখ খানকেও মানাতে হয়েছিল। যেখানে এই বছরই সঞ্জীব গোয়েন‌্কার লখনউ থেকে গম্ভীরকে ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কিং খান, এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে একেবারেই রাজি ছিলেন না।

কিন্তু কেকেআরের মেন্টর হওয়া আর ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ভিত্তিক লিগ আর জাতীয় দলকে নিয়ে আবেগ এক নয়। কেকেআরের সাফল্যে আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, রিঙ্কু সিংহদের নিয়ে নাচানাচি হয়েছে। এমনকি, এই সাফল্যকে শাহরুখের সাফল্য হিসাবেও দেখেছেন অনেকে। কিন্তু গম্ভীর, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত (কেকেআরের কোচ)-দের নিয়ে এই উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। একই রকম ভাবে দল হারলেও শ্রেয়স আয়ারদের যে ভাবে ছিঁড়ে খাওয়া হত, শাহরুখকে তুলোধনা করা হত, গম্ভীর, পণ্ডিতরা তখনও সে ভাবে আলোচনায় আসতেন না। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে ছবিটা ঠিক উল্টো। পান থেকে চুন খসলে সবার আগে কোচের মুণ্ডপাত করা হবে। মাথাগরম করার হাজারো নিদর্শন বয়ে বেড়ানো গম্ভীর কি তখন মাথা ঠান্ডা রাখতে পারবেন? না কি সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকারদের সঙ্গে রোজ খটাখটি লাগবে তাঁর? না কি আপটনের কথা মানলে নিজের স্বভাব অনুযায়ী আরও হতাশা এবং নৈরাশ্যবাদে ডুবে যাবেন গম্ভীর?

এর একটা জবাব আছে ওয়াসিম আক্রমের কাছে। তিনি বলেছেন, ‘‘জিজি (গম্ভীরকে এই নামে ডাকেন অনেকেই) খুব সরল। স্পষ্টবক্তা। একেবারেই গোলমেলে লোক নয়। কিন্তু ও খুব চাঁছাছোলা ভাষায় কথা বলে। বলার আগে দু’বার ভাবে না। এটা দোষ না গুণ জানি না, কিন্তু এটুকু জানি, এটা ভারতীয় ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। ভারতীয় সংস্কৃতি মানে সেই সব কথা বলতে হয়, যা শুনলে লোকে রাগ করবে না, কেউ অসন্তুষ্ট হবে না, সবাই শুধু ‘বাঃ বাঃ’ করবে। কিন্তু জিজি এমন একজন, কোনও জিনিস পছন্দ না হলে মুখের উপর বলে দেবে। এই জন্যই সবাই ওকে পছন্দ করে। আবার এই জন্যই সবাই ওকে আড়ালে গালিও দেয়। মাঝেমাঝেই মাথাগরম করে ফেলে ও। এখন দেখার, এই আগ্রাসনটা ও দলের মধ্যে আনতে পারে কি না।’’ আগ্রাসন আর মাথাগরম এক জিনিস নয়। প্রথমটা যদি কোহলির থাকে, দ্বিতীয়টা আছে গম্ভীরের। মাথাগরম করা লোক এবং চরম আগ্রাসন থাকা একটা লোক একই সঙ্গে একই সংসারে থাকতে পারবেন তো? কোহলির সঙ্গে গম্ভীরের ঝামেলা, চোখরাঙানি, কথা কাটাকাটির দীর্ঘ ইতিহাস সর্বজনবিদিত।

গম্ভীর যে কড়া হেডস্যর, সেটা কেকেআরে এসে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ রকম মাস্টারমশাই একেবারেই পছন্দ নয় ভারতীয় দলের। তার প্রমাণ অনিল কুম্বলে। রোহিত, কোহলিরা কুম্বলের কোচিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। প্রাণ এতটাই ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল, কুম্বলেকে তাড়ানোর জন্য সবাই মিলে দল বেঁধে চিঠি দিয়ে বোর্ডের কাছে দরবার করেছিলেন। সরে যেতে হয়েছিল কুম্বলেকে।

Former India coach Anil Kumble and former captain Virat Kohli

কড়া কুম্বলেকে নিয়ে কোহলিরা কতটা অখুশি ছিলেন, সেটা তৎকালীন বোর্ড প্রশাসকদের প্রধান বিনোদ রাই তাঁর বই ‍‘নট জাস্ট এ নাইটওয়াচম্যান: মাই ইনিংস উইথ বিসিসিআই’-এ লিখেছেন। রাইয়ের কথায়, ‘‍‘তৎকালীন ভারত অধিনায়ক ও দল পরিচালন সমিতির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাঁরা আমাকে জানান, কুম্বলে শৃঙ্খলাকে অসম্ভব গুরুত্ব দিয়ে চলেন। আর সেটা দৃঢ় ভাবে আরোপ করতে চান। যা অনেকের পছন্দের নয়। তখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলি দলের অধিনায়ক কোহলির সঙ্গে। তিনি বলেন, দলের তরুণ ক্রিকেটারেরা কোচের ব্যবহারে বেশ বিব্রত। এর পরেই সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভিভিএস লক্ষ্মণদের নিয়ে গঠিত ক্রিকেট উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে কথা বলি। বিষয়টির সমাধানের জন্য লন্ডনে কোচ ও অধিনায়কের সঙ্গেও কথা হয়। কিন্তু ক্রিকেট উপদেষ্টা কমিটির তরফে কুম্বলেকেই ফের কোচ হিসেবে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিদেশ থেকে ফেরার পরে কুম্বলের সঙ্গে আবার কথা হয়। যা ঘটেছে, তা নিয়ে কুম্বলে খুব বিমর্ষ ছিল। কুম্বলের মনে হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে ঠিক ব্যবহার করা হয়নি। অধিনায়ক বা ক্রিকেটারদের এতটা গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। দলে শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব ফেরাতে কোচের একটা ভূমিকা থাকে। কুম্বলে চাইত, ওর দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করুক ক্রিকেটারেরা।’’

এর পর পদত্যাগ করেছিলেন কুম্বলে। পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘‘আমাকে জানানো হয়েছে, কোচ হিসাবে আমার কর্মপদ্ধতি এবং উপস্থিতি নিয়ে অধিনায়কের আপত্তি রয়েছে। খুবই অবাক হয়েছি। কারণ আমি সব সময়ই মনে করেছি কোচ এবং অধিনায়কের আলাদা সীমা থাকা উচিত।’’

গম্ভীর কোচ হচ্ছেন শুনে ভুক্তভোগী কুম্বলে সবার আগে আসরে নেমেছেন। বলেছেন, ‘‘ভারতীয় কোচের পদটা একটু আলাদা। ভারতের কোচ হওয়া সহজ নয়। ওকে একটু সময় দিতে হবে।’’ সেই সময় কি গম্ভীর পাবেন? অপেক্ষা করে থাকতে হবে গম্ভীর মুখে। ছাত্রদের নয়, এই পরীক্ষা হেডস্যরের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.