দৃষ্টান্ত১: সোমবার রাতে ফিয়ার্স লেনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে গিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি তথা অধুনা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাতজাগা আন্দোলন থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘অভিজিৎ গাঙ্গুলি গো ব্যাক’! এক জুনিয়র ডাক্তার তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, ‘‘আপনি চলে যান। এখানে দাঁড়াবেন না। কথা বাড়াবেন না। চলে যান। চলে যান।’’
দৃষ্টান্ত ২: মঙ্গলবার দুপুরে একটি ভিডিয়োয় তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের কয়েক জন গিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের পরেই পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের জট কেটেছে। কিন্তু জুনিয়র ডক্টর্স ফোরামের অন্যতম মুখ তথা অভিনেতা কিঞ্জল নন্দ স্পষ্ট বলেন, ‘‘এটা সর্বৈব মিথ্যা। যাঁরা কুণালের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁরা জুনিয়র ডাক্তার ফোরামের কেউ নন।’’ কিঞ্জল আরও জানিয়ে দেন, তাঁদের আন্দোলনে রাজনীতির ‘প্রবেশ নিষেধ’।
দৃষ্টান্ত ৩: মঙ্গলবার বিকালে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঠাসা ভিড়ের মাঝে মাইক-বাঁধা ম্যাটা়ডোরে উঠে বক্তৃতা করছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। নেতাজি মূর্তির নীচে দাঁড়ানো এক মহিলা হঠাৎ হিন্দিতে চিৎকার করতে শুরু করেন, ‘‘আপনারা রাজনীতির কথা কেন বলছেন? কেন দলাদলির কথা বলছেন? ধর্ষণ কাণ্ডের বিচারের কথা কই?’’
দৃষ্টান্ত ৪: চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সংহতি জানাতে গত শনিবার আরজি কর হাসপাতালে গিয়েছিলেন অধীর চৌধুরী। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অধীর জানিয়েছিলেন, নেতা নন। তিনি সাধারণ নাগরিক হিসাবে একটু জল দিতে চান ধর্নারত চিকিৎসকদের। চিকিৎসকেরা বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দেন, তাঁদের তহবিল রয়েছে। জলের কোনও অসুবিধা নেই। তাঁরা রাজনীতির পরিচয়ের কাউকে আন্দোলনে ঢুকতে দেবেন না।
প্রথম তিনটি দৃষ্টান্ত গত ২৪ ঘণ্টার। চতুর্থটি গত শনিবারের। যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে নাগরিক আন্দোলনের কাঁটাতারে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে রাজনীতির ‘অবাঞ্ছিত’ অনুপ্রবেশ। প্রবীণেরাও বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে নজিরবিহীন আন্দোলন চলছে। অতীতের কোনও কিছুর সঙ্গে যার তুলনা চলে না। যে আন্দোলনের কোনও রাজনৈতিক রং নেই। দল নেই। আছে শুধু নাগরিক গর্জন। আছেন আন্দোলকারী ডাক্তারির পড়ুয়ারা। আছে চিকিৎসক সমাজ। আছেন সাধারণ মানুষ। যাঁদের সাগ্রহ উপস্থিতি বারবার বলে দিচ্ছে, কোনও রাজনৈতিক দলের উপরেই তাঁদের আর ‘আস্থা’ নেই।
সেই আন্দোলনের গর্জনের সামনে দাঁড়াতে পারেননি বিচারপতি থাকাকালীন সমাজের একটি বড় অংশের নজরে ‘ঈশ্বর’ বলে প্রতিভাত সাংসদ অভিজিৎ। দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে। কারণ, জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা কোনও রাজনীতি চান না। যেমন তৃণমূলের কুণাল যতই ভিডিয়ো প্রকাশ করে দাবি করুন, তাঁর ‘মধ্যস্থতা’ ছিল বলেই পুলিশের সঙ্গে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে অবস্থানরত জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনায় বরফ গলেছে, চিকিৎসকেরা তাঁর দাবি নস্যাৎ করে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতি চান না। তাঁরা কুণালের কাছে কোনও প্রতিনিধিকে পাঠাননি। পাঠানোর প্রশ্নও ওঠে না। সেই চিকিৎসকদের অনড় আন্দোলনেই হটে গিয়েছে ৯ ফুট উঁচু লৌহকপাট। কোনও রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডার প্রয়োজন পড়েনি। যেমন মঙ্গলবার শ্যামবাজারে সেলিমের কানে একা মহিলার সেই চিৎকার পৌঁছয়নি। কিন্তু মহিলাকে সামাল দিতে কার্যত হিমশিম খেতে হয়েছে সিপিএমের মহিলা বাহিনীকে।
নাগরিক আন্দোলনের ঢেউয়ে নতুন ধারাপাত দেখছে পশ্চিমবঙ্গ।
প্রবীণ সিপিএম নেতা বিমান বসুর বক্তব্যে যার প্রতিধ্বনি, ‘‘১৯৫২ সাল থেকে কোন আন্দোলনের মাত্রা কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। ১৯৫৩ সালে ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে উত্তাল আন্দোলন হয়েছিল। ১৫ দিনে দু’বার ধর্মঘটও হয়েছিল। কিন্তু এ রকম হয়নি।’’ কিন্তু বিমান বলেছেন রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস। আরজি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কল্কে পাচ্ছে না প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক কোনও দল। রাজনৈতিক স্লোগান উঠছে না যে তা নয়, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান হচ্ছে। কিন্তু সবটাই হচ্ছে দলহীন জমায়েত, মিছিল, সভা থেকে। যে জমায়েতে বেশি বেশি করে জায়গা নিচ্ছে জাতীয় পতাকা। উড়ছে লিঙ্গসাম্যের প্রতীক রামধনু পতাকা। শহরের বড় স্কুলের প্রাক্তনীরা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বলছেন, ‘‘আমরা পরিবর্তনের কথা বলছি না। আমরা বিচার চাইছি আর নারীসুরক্ষার দাবি করছি।’’
এর সূত্রপাত গত ১১ অগস্ট রাতে। সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতানেত্রীদের আরজি কর হাসপাতালে ঢুকতে দেননি জুনিয়র ডাক্তারেরা। তার পর ১৪ অগস্ট রাতে ‘মেয়েদের রাত দখল’ এক অভূতপূর্ব ছবি তৈরি করেছিল সারা বাংলায়। সেই কর্মসূচিতেও পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক দলের পরিচিত মুখেরা থেকেছেন পিছনের সারিতেই। কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু সিপিএম বা বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্বকে অরাজনীতির ‘মোড়ক’ রাখতে হয়েছে। তার পর থেকে অনেক আন্দোলন হয়েছে। হচ্ছে। হবেও। দেখা গিয়েছে, ‘দলহীন’ কর্মসূচিতে জনসংখ্যা এবং সাড়া অনেক বেশি। জমায়েত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত। মঙ্গলবার বামেদের মিছিলে লোক খারাপ হয়নি। বিজেপি ১২ ঘন্টার বাংলা বন্ধ ডেকে সংগঠনকে নামানোর চেষ্টা করেছিল। কংগ্রেসও কলেজ স্কোয়্যার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিল করেছিল। কিন্তু তার কোনওটিই অরাজনৈতিক জমায়েত এবং তার মেজাজকে টেক্কা দিতে পারেনি।
গত ১ সেপ্টেম্বর নাগরিক মিছিল শেষে সারারাত ধর্মতলায় অবস্থানে বসেছিলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সোহিনী সরকারেরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন অসংখ্যা সাধারণ মানুষ। সারা রাত গান-কবিতা নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন তাঁরা। বিচার চেয়েছেন। সেই বিচারের বাদিতে আরজি করের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল উন্নাও, হাথরসও। কিন্তু সেই প্রতিবাদ এবং দাবি ছিল ‘দলহীন’। সেখানে অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘বাংলায় একটা নতুন দল চাই। সকলকেই তো দেখা হয়ে গেল!’’
আপাতত এই ‘অরাজনৈতিক’ মোড়ককেই রুপোলি রেখা হিসাবে দেখছে শাসক তৃণমূল। দলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘রাজ্য শাসন তো সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ করবে না। রাজ্য শাসন করবে পলিটিক্যাল সোসাইটি। অর্থাৎ সরকার। মানছি, আমাদের অনেক ভুল হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিকল্প কি বিজেপি?’’
সিপিএম ৩৪ বছর সরকার চালিয়েছে। সেই স্মৃতি টাটকা। বিজেপি পরপর ভোটে পরাস্ত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। সেই ক্ষোভ ভেঙে দিচ্ছে রাজনীতির ‘আধিপত্যবাদ’। তৈরি হচ্ছে নাগরিক স্বতঃস্ফূর্ততা। যে স্বতঃস্ফূর্ততাকে প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেসের নেতারা। তবে আবডালে তাঁদের অনেকে বলছেন, আন্দোলনের নতুন ধারা তো এল। এর পর?