শুধুমাত্র আরজি কর নয়, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে বাংলার পাঁচ মামলা ‘অমীমাংসিত’

সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই দেশের প্রধান বিচারপতি পদে সময় ফুরিয়ে গেল ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের। তাঁর বেঞ্চে চলা মামলাগুলির নিষ্পত্তির আগেই চলে এল তাঁর অবসরের দিন। শুক্রবার শীর্ষ আদালতে ছিল চন্দ্রচূড়ের কর্মজীবনের শেষ এজলাস। খাতায়কলমে অবশ্য তাঁর অবসরের দিন আগামী রবিবার, ১০ নভেম্বর। তবে শনিবার এবং রবিবার আদালত ছুটি। সেই কারণে শুক্রবারই শেষ বার বিচারপতির আসনে বসলেন চন্দ্রচূড়। শীর্ষ আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছিল শুক্রবারেই। চন্দ্রচূড়ের ফেলে যাওয়া অমীমাংসিত মামলাগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মামলা রয়েছে। কবে শীর্ষ আদালতে সেই সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি হবে, তা স্পষ্ট নয়। আগামী সোমবার দেশের প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নেবেন বিচারপতি সঞ্জীব খন্না।

সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি হিসাবে চন্দ্রচূড়ের অভিষেক ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রায় ঘোষণা করেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি কখনও সাধারণ বিভাগীয় পদ্ধতি মেনে তাঁর বেঞ্চে গিয়েছে, কখনও আবার প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু শুরু করলেও কিছু মামলার শেষ দেখে যেতে পারলেন না তিনি।

আরজি কর মামলা

সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসাবে অতি সম্প্রতি আরজি করে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুন এবং তৎপরবর্তী ঘটনাবলি সংক্রান্ত মামলাটির উল্লেখ করা যায়। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই মামলায় হস্তক্ষেপ করেছিল চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। গত ১৮ অগস্ট মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়, প্রথম শুনানি হয় ২০ অগস্ট। বৃহস্পতিবারও আরজি কর মামলা শুনেছেন প্রধান বিচারপতি। এই মামলায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে তাঁর। সিবিআইয়ের তদন্তের রিপোর্ট দেখে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। উইকিপিডিয়া এবং সমাজমাধ্যম থেকে নির্যাতিতার নাম মুছে দিতে বলেছিলেন। হাসপাতালে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি।

আরজি করের ঘটনার পর রাজ্য সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাঁদের রাতের ডিউটি দেওয়া হবে না। এই বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করতে বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি। মহিলাদের জন্য কেন এমন সীমারেখা টেনে দেওয়া হচ্ছে, প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, আরজি কর-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত সিভিক হওয়ায় হাসপাতালের নিরাপত্তায় চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল তাঁর বেঞ্চ থেকে। আগামী ১০ ডিসেম্বর শীর্ষ আদালতে আরজি কর মামলাটির পরবর্তী শুনানির সম্ভাবনা। তবে তখন চন্দ্রচূড় থাকবেন না।

ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল মামলা

দুর্নীতির অভিযোগে কলকাতা হাই কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের ১২ লক্ষের বেশি ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি) সার্টিফিকেট বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে। চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ সেই মামলাটি প্রথম বার শোনে গত ১৮ জুন। হাই কোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়নি শীর্ষ আদালত। রাজ্যের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট চেয়েছিলেন চন্দ্রচূড়। কারা ওবিসি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী ভাবে তা নির্ধারণ করে, কিসের ভিত্তিতে ওবিসি শংসাপত্র দেওয়া হয়, জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই মামলার খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। বৃহস্পতিবারও শীর্ষ আদালতে মামলাটির প্রসঙ্গ ওঠে। দ্রুত শুনানির আর্জি জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। আগামী ১৩ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।

২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলা

এসএসসি দুর্নীতি মামলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। ফেরত দিতে বলা হয়েছিল বেতন। সেই মামলাটিও সুপ্রিম কোর্টে যায়। হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য সরকার। পৃথক ভাবে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। তার পর সুপ্রিম কোর্টে দফায় দফায় মামলা করেন হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরিহারাদের কয়েক জন। গত ২৪ জুলাই এই মামলার প্রথম শুনানি হয় প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে। শীর্ষ আদালত এ ক্ষেত্রে হাই কোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, আগামী দিনে শীর্ষ আদালতের রায়ের উপরেই ২৬ হাজার চাকরির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। কিন্তু এখনও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। যাঁরা ওই চাকরি করছেন, তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন। আগামী ১৯ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি হতে পারে শীর্ষ আদালতে।

রাজভবনে শ্লীলতাহানির মামলা

গত জুলাই মাসে পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে এক অস্থায়ী মহিলা কর্মী শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিলেন। খোদ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনেন তিনি। হেয়ার স্ট্রিট থানায় লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন। কিন্তু রাজ্যপাল পদাধিকার বলে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেয়ে থাকেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি পুলিশ। সেই মামলাটিও সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে গত ১৯ জুলাই এক বারই এই মামলার শুনানি হয়। তাতে নোটিস জারি করেছিল প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে এই মামলায় যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পর ওই মামলাটি আর শুনানির জন্য ওঠেনি। কোনও অগ্রগতিও হয়নি।

মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি মামলা

গত জানুয়ারি মাসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি মামলা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি সৌমেন সেনের মধ্যে সংঘাত বড় আকার নিয়েছিল। মেডিক্যালে ভর্তি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বিচারপতি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়। তার পরেই ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ‘ত্রুটি’ উল্লেখ করে ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশই তিনি খারিজ করে দেন এবং সিবিআইকে তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেন। বেনজির এই সংঘাতের আবহে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। শনিবার ছুটির দিনে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে এই মামলা শোনে চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। মেডিক্যালে ভর্তি সংক্রান্ত সমস্ত মামলা হাই কোর্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, কলকাতা হাই কোর্টে ডিভিশন বেঞ্চ এবং সিঙ্গল বেঞ্চ নিয়ে যা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট তা ভাল চোখে দেখছে না। এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য তাঁরা করবেন না। তাতে হাই কোর্টের গরিমা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ২৭ জানুয়ারি এই মামলাটি প্রথম বার শীর্ষ আদালতে ওঠে। শেষ বার শুনানি হয়েছে ২৯ জানুয়ারি। মেডিক্যালে ভর্তি বা দুই বিচারপতির সংঘাত, কোনও ক্ষেত্রেই আদালতে আর কোনও অগ্রগতি হয়নি। ১৮ নভেম্বর মামলার শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.