আমাকে এক জন রোগীও বলেননি যে, জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে ফেরা উচিত

প্রায় ১ মাস হতে চলল। আরজি কর-কাণ্ডে এখনও রাজ্য তথা দেশ জুড়ে আন্দোলন চলছে। ৯ অগস্ট সকালবেলা আমি তখন সবে একটা অস্ত্রোপচার শেষ করেছি। তার পরেই মর্মান্তিক খবরটা পাই। মন ভেঙে যায়। কারণ, আমরাও তো একদিন ডাক্তারি পড়তে এসেছিলাম। আমি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী। আমরাও একসময়ে লেবার রুমে তবলা বাজিয়ে গান গেয়েছি, দল বেঁধে নাইট ডিউটি করেছি। অন্য একটা জীবন ছিল। সেখানে এ রকম ঘটনা যে কোনও মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে ঘটতে পারে, ধারণা ছিল না!

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন এখন আর শুধুই চিকিৎসকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রত্যেকেই একটা সুস্থ সমাজ গড়ার দাবিতে লড়াই করছেন। এবং অবশ্যই নির্যাতিতার সুবিচারের জন্য লড়াই করছেন।

বিগত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই। জানতাম, পাড়ায় বাড়ি তৈরি হলে কোনও নির্দিষ্ট এক জনের থেকে ইট, বালি, সিমেন্ট না নিলে নাকি নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এখন স্বাস্থ্য পরিষেবার মধ্যেও ‘সিন্ডিকেট’ ব্যবস্থার উপস্থিতি— এক জন বর্ষীয়ান চিকিৎসক হিসাবেএটা শুনতে খারাপ লাগে। কারণ সত্যি বলছি, প্রচুর পরিশ্রম করে একটি ছেলে বা মেয়ে চিকিৎসক হয়ে ওঠে। সেখানে শুনছি, অর্থের বিনিময়ে এখন ডিগ্রি পাওয়া সম্ভব। এমনকি, পাশ-ফেলও কাউকে করিয়ে দেওয়া যাচ্ছে! এদেরকে আমার চিকিৎসক বলতেও লজ্জা করে। এই সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে হবে। ইচ্ছে করে চিকিৎসকেদের ভাবমূর্তি খারাপ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার উপরে কাঞ্চন মল্লিক বা লাভলি মৈত্রের মতো কয়েক জন অশিক্ষিতের মতো কথা বলছেন! যা মুখে আসে, তা-ই কিন্তু বলা যায় না। অসুস্থ হলে তো সেই আমাদের কাছেই আসতে হবে তাঁদের। আমি এই দাবিও করছি, কয়েক জনের জন্য সকলকে খারাপ ভাববেন না।

আরজি করের ঘটনায় নেপথ্যে যে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ উঠে আসছিল, তা তো প্রায় সত্য। প্রতি দিন নানা প্রশ্ন উঠছে। সবাই জানেন সেগুলো। কেন দ্রুত নির্যাতিতার শেষকৃত্য করা হল? কেন এফআইআর দেরিতে হল? কেন সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেল না? অপরাধের পর কলেজের অধ্যক্ষকেই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করল না! ময়নাতদন্ত কখন করা যায়, তার নিয়ম আছে। ক্রাইম সিনের ভিডিয়োতেও দেখলাম, গিজগিজ করছে লোক! সেখান থেকে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা তো অসম্ভব বিষয়! এক জন মদ্যপকে দেখিয়ে গ্রেফতার করে যে সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা বেশ স্পষ্ট। তার থেকেও বড় কথা, সেরা ছাত্রেরা ডাক্তারি পড়তে আসে। তাদের বোকা বানানো এত সহজ নয়।

জুনিয়র চিকিৎসকেরা আমার ছোট ভাইয়ের মতো। কী সুন্দর ভাবে একটা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, আমার দেখেও ভাল লাগছে। মিছিল, অবস্থান, তার পর লালবাজার— ওঁদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অতুলনীয়। বিশেষ করে কিঞ্জল (কিঞ্জল নন্দ) একজন শক্তিশালী অভিনেতাও বটে। ও এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছে। সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন আমাদের আন্দোলনকে হাতিয়ার করতে চাইছে তাদের স্বার্থে। কিন্তু পারেনি! চিকিৎসকেরা তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আমরা বুড়ো মাথারাও ওঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে রাজি।

জুনিয়র চিকিৎসকেদের কর্মবিরতি নিয়ে নানা আলোচনা শুনছি। কেউ বলছেন, চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু, সিনিয়র চিকিৎসকেরা তাঁদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। চিকিৎসকেরা কেন প্রতিবাদ করবেন না, বলুন তো! তাঁদের একজন সহকর্মীর সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার প্রতিবাদ ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত চলবে। একটা-দুটো বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে ‘বড়’ করে দেখানো হচ্ছে। কই, পাশাপাশি যে ‘অভয়া ক্লিনিক’ চলছে, সেটা নিয়ে তো সেই ভাবে কোনও কথা বলা হচ্ছে না? চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ এবং শ্রদ্ধাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চক্রান্ত হচ্ছে। আর বিশ্বাস করুন, গত এক মাসে আমি প্রায় দেড়-দু’হাজার রোগী দেখলাম। প্রত্যেকের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু এক জন রোগীও কিন্তু আমাকে বলেননি যে, জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা উচিত। উল্টে আমাকে অনেকেই বলেছেন, সিনিয়র হিসেবে আমাদেরও আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। তা হলে ছোটরা মনে জোর পাবেন।

করোনার পর থেকে আমি আর ধারাবাহিকে অভিনয় করি না। সময়ের বড্ড অভাব। ৮০ বছর বয়সেও এখনও নিয়মিত রোগী দেখে চলেছি। কিন্তু নাটকে (‘জলসাঘর’) এখনও অভিনয় করছি। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও আমি সব খোঁজখবর রাখি। খুবই নির্মম ভাবে শিল্পীদের ট্রোল করা হচ্ছে। এটা উচিত নয়। শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা সত্যিই বন্ধু, যাঁরা কাঞ্চনের মতো নন, তাঁরা তো সত্যিই এই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমাদের হাত ধরেছেন। মঙ্গলবারেও একটা মিছিলে আমার সঙ্গে ভেবলির (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) দেখা হল। আমাকে দেখেই এসে জড়িয়ে ধরেছিল। ওকে দেখেই বুঝতে পারি, চোখে ঘুম নেই। জিজ্ঞাসা করতেই জানাল, দু’রাত ঘুমোয়নি। আবার দিনের বেলার শুটিং করছে। ওকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করি। আমার প্রশ্ন, যাঁরা ট্রোল করছেন, তাঁরা কি আমাদের পাশে হাঁটছেন, না কি নেহাতই কিছু পয়সা পাওয়ার লোভে কারও হয়ে সমাজমাধ্যমে কথা বলছেন? এই সব করে আমাদের দমানো সম্ভব নয়।

সম্পূর্ণ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্য, সিবিআই সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করেছে। আমার মতো সারা দেশের মানুষ আরজি কর-কাণ্ডের পরবর্তী শুনানির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কী হবে, জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, যত দিন না পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, তত দিন আমাদের আন্দোলন চলতেই থাকবে। এক মাস, দু’মাস বা এক বছর। আমাদের প্রতিবাদ জারি থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.