হাতে একটা কলম ধরিয়ে দিলে নারায়ণ দেবনাথকে নিয়ে আমি পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি। তাঁর কমিকস নিয়ে, অলংকরণ নিয়ে, প্রচ্ছদ নিয়ে এমনকী মানুষটিকে নিয়ে লিখে ফেলতে পারি অনেক কিছু। কিন্তু আজ যেন কলম চলতেই চাইছে না। এ-লেখা সেই লেখা, যা কখনও লিখতে হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
২০০২ সাল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে দুরুদুরু বুকে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই আমি ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেটর হিসাবে কাজ শুরু করেছিলাম ‘শুকতারা’ ও ‘নবকল্লোল’ পত্রিকায়। আমার বয়স তখন ১৬। থাকতাম শান্তিনিকেতনে। প্রায় প্রতি মাসে একবার করে ঝামাপুকুর লেনের দফতরে যেতাম আঁকা জমা দিতে, আর অলংকরণের জন্য নতুন পাণ্ডুলিপি আনতে। সেই দিনটার জন্য আমি সারাটা মাস অপেক্ষা করে থাকতাম। কারণ দেব সাহিত্য কুটিরের দফতরটা ছিল আমার কাছে এক কল্পরাজ্যের মতো। কোনও দিন হয়তো সেখানে গিয়ে ইলাস্ট্রেশনের জন্য অদ্রীশ বর্ধনের পাণ্ডুলিপি হাতে আসে, কোনও দিন হয়তো আলাপ হয়ে যায় অনীশ দেবের সঙ্গে। কখনও বা দেখি মানবেন্দ্র পালের নতুন ভৌতিক উপন্যাসের প্রুফ দেখা চলছে আগামী শুকতারা শারদীয়ার জন্য। তেমনই একদিন দফতরের কোনও একটা টেবিলে আবিষ্কার করলাম দু’পাতা ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিকস। সম্পূর্ণ নতুন, তবে সাদা-কালো। বাঁটুলের পোশাকে যে গোলাপি রং থাকে— সেটা এখানে নেই। তার বদলে উপরে একটা ট্রেসিং পেপারে গ্রে কালারে পোশাকের জায়গাগুলো ভরাট করা হয়েছে। পাতাগুলো আরও ভালোভাবে দেখব বলে হাতে নিতেই চমকে উঠলাম। এ যে আগামী সংখ্যার শুকতারায় প্রকাশিতব্য নতুন বাঁটুল কমিকস! নারায়ণ দেবনাথের নিজের হাতে আঁকা পাতা! এত নিখুঁত আর ঝকঝকে যে ছাপা বলে ভ্রম হয়। সেই পাতা দুটো হাতে নিয়ে বসেছিলাম বহু ক্ষণ। রেখাগুলোয় আঙুল বুলিয়েছিলাম। ছোট থেকে নারায়ণ দেবনাথের কমিকস পড়ে বড় হয়েছি। কিন্তু শিল্পীর হাতে আঁকা পাতা ছুঁয়ে দেখার সেই রোমাঞ্চ কয়েকটি শব্দে বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। ময়দানে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলছে এমন এক কিশোরের হাতের মুঠোয় যদি কখনও চলে আসে সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাট, তার যেমন অবস্থা হবে আমার অবস্থাও ঠিক তেমনই তখন।ট্রেন্ডিং স্টোরিজ
এই ঘটনার ন’বছর পরে বন্ধু শান্তনু ঘোষ আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে। সেই প্রথম সামনাসামনি কথা বলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘জেঠু’। সরল সদালাপী মানুষ। বাংলা কমিকসের প্রবাদপুরুষ। তিনি একা হাতে বাংলা কমিকসকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, তা পরবর্তীকালে আর কেউ পারবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অথচ মানুষটির মধ্যে কোনও অহংকারের লেশমাত্র দেখিনি কোনও দিন।
যত দূর জানা যায়, গত শতকের চল্লিশের দশকে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ন দেবনাথ। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই অস্থির সময়ে ৬ বছরের কোর্সের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার দেওয়া হয়নি তাঁর। এর পরে কাজের সন্ধানে ১৯৪৯-৫০ সাল নাগাদ মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি যোগ দিয়েছিলেন সাহিত্য কুটির-এ ইলাস্ট্রেটর হিসেবে। শুকতারা পত্রিকায় তিনটি ছবি এঁকে পেয়েছিলেন মোট ৯ টাকা। ১৯৬২ থেকে তিনি কমিকস করতে শুরু করেছিলেন শুকতারার পাতায়— হাঁদা ভোঁদা। বাঁটুল শুরু হয়েছিল আরও কয়েক বছর পর, ১৯৬৫ সালে। এখন এই ২০২২-এ বসে ভাবতে অবাক লাগে যে মানুষটি প্রায় ৬০ বছরের সুদীর্ঘ সময়কাল ধরে এঁকে গিয়েছেন একের পর এক কমিকস। প্রতি মাসে একটি করে হাঁদা ভোঁদা ও বাঁটুল দি গ্রেট আঁকতেন শুকতারার জন্য এবং একটি নন্টে ফন্টে কমিকস আঁকতেন কিশোর ভারতীর জন্য। সঙ্গে শুকতারা প্রচ্ছদের জন্য প্রায়শই থাকত হয় বাহাদুর বেড়াল বা গোয়েন্দা কৌশিকের রঙিন কমিকস। প্রতিমাসে চারটি করে নতুন কমিকসের গল্প ভাবা, চিত্রনাট্য তৈরি করা ও প্যানেলের পর প্যানেল এঁকে যাওয়া যে কী অসম্ভব এক কাজ, সেটি ভাবতেও শিহরন জাগে। এক্ষেত্রে শুধু গল্প ভাবলেই হয় না, এমন গল্প ভাবতে হয়, যে গল্প শেষ হবে ২ পাতার মধ্যে। সেই অসম্ভব কাজ তিনি করে গিয়েছেন, বলা ভালো অবলীলায় করে গিয়েছেন বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে। এর আগে একই সঙ্গে কমিক্যাল ও সিরিয়াস কমিকস এত সফলভাবে বাংলায় কেউ কখনও করেননি। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য অলংকরণ ও প্রচ্ছদের কাজ। সেই কাজেও দক্ষতার দিক দিয়ে তার সমকক্ষ শিল্পী বাংলায় খুব কমই ছিলেন।
নারায়ণ দেবনাথ প্রয়াত হলেন। রেখে গেলেন তাঁর সৃষ্ট অসংখ্য চরিত্র, যা তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে, তাঁরই মতো। আর রেখে গেলেন এক অপূরণীয় শূন্যস্থান। তবে তিনি বাংলা কমিকসকে যে হীরকখচিত সোনার মুকুটটি পরিয়ে দিয়ে গেলেন, তার ঔজ্জ্বল্য বাঙালি শিল্পীদের আরও বহু বহু বছর আলো দেখাবে।
(লেখক পেশায় কার্টুনিস্ট এবং চিত্রশিল্পী)