দেশের পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের, বিশেষত পসমন্দা সমাজকে কাছে টানতে দলীয় কর্মীদের এগিয়ে আসতে বলেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আবার লোকসভা ভোটের প্রচারে নেমে হিন্দু ভোটের মেরুকরণের লক্ষ্যে মুসলিমদের সব থেকে বেশি আক্রমণ শানিয়েছেন সেই মোদীই। ভোট-বিশেষজ্ঞদের মতে, মোদীর এমন বিপরীত অবস্থান আখেরে বিজেপির মুসলিম ভোটকে কাছে টানার উদ্যোগেই পুরোদস্তুর জল ঢেলে দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব ঘরোয়া ভাবে মানছেন, তীব্র মেরুকরণের হাওয়া ইন্ডিয়া মঞ্চকেই মুসলিমদের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে ফায়দা করে দিয়েছে।
মুসলিম সমাজ যে ঢালাও ভাবে বিজেপির সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারে, সেই বার্তা দিয়েছিল ২০২২ সালের উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। তার পরেই পসমন্দা সমাজের মন জয়ে একাধিক আস্থাবর্ধক পদক্ষেপ করে গেরুয়া শিবির। দল ঠিক করে, মেরুকরণ নয়, প্রচার হবে উন্নয়নকে সামনে রেখে। কিন্তু উন্নয়নের ফিরিস্তি কিংবা রাম মন্দির— বিজেপির হাওয়া তুলতে ব্যর্থ হয় সব অস্ত্রই। রাজনীতির অনেকের মতে, লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফাতেই বিজেপি নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, গেরুয়া শিবিরের পক্ষে কোনও ভোটের হাওয়া নেই। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘এই আবহে ক্ষমতা ধরে রাখতে হিন্দু ভোটকে একজোট করা ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে হাঁটতে হয়েছে মেরুকরণের পুরনো রাস্তাতেই।’’ আর তাই প্রথম দফার ভোটের পরেই কংগ্রেসের ইস্তাহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ খুঁজে পেয়েছেন মোদী। মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, কংগ্রেস মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে হিন্দুদের বাড়তি সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। উস্কে দিয়েছেন লাভ জেহাদ প্রসঙ্গও।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের ‘দিল্লিবাড়ির লড়াই’ -এর পাতায়।চোখ রাখুন
বিজেপির সংখ্যালঘু শাখার এক নেতার মতে, প্রথম দফার পর থেকে যে চড়া তারে মুসলিমদের আক্রমণের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন মোদী, তার পরে মুসলিম সমর্থন পাওয়া যে দুরাশা, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আক্রমণের তীব্রতা যত বেড়েছে, বিজেপির থেকে ততই দ্রুত মুখ ফিরিয়েছে মুসলিম সমাজ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ দেশের মুসলিম সমাজের অন্তত আশি শতাংশই পিছিয়ে থাকা পসমন্দা সমাজের। সারা দেশে পসমন্দা মুসলিমের সংখ্যা ১৮-২০ কোটির কাছাকাছি। এই ভোটব্যাঙ্ককে পাশে পেতে ২০২২ সালে হায়দরাবাদে হওয়া জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে দলীয় কর্মীদের এগিয়ে আসতে বলেছিলেন মোদী। বিজেপির এক নেতার ব্যাখ্যা, এ ভাবে দলীয় মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেওয়া যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এর নেপথ্য কারণ ছিল ওই বছরেই হওয়া উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। উত্তরপ্রদেশের মোট জনসংখ্যার ২০-২২ শতাংশ মুসলিম। ভোটের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেই রাজ্যের অন্তত ৮-৯ শতাংশ মুসলিম যোগী আদিত্যনাথের সমর্থনে এগিয়ে এসে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। উন্নয়নকে সামনে রেখে গেরুয়া শিবির যে মুসলিম সমাজেরও ভোট পেতে পারে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় ওই বিধানসভা নির্বাচনে। তার পর থেকেই তাঁদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু তাতে এই লোকসভায় লাভ হয়েছে বলে মনে করছে না বিজেপি।
উত্তরপ্রদেশ ও বিহার, এই দুই রাজ্যে বড় সংখ্যক পসমন্দা সমাজের মানুষ বসবাস করেন। বিজেপি ওই দুই রাজ্যে এ বার তাঁদের সমর্থন পাবে বলেই আশা করেছিল। গত বিধানসভায় পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মুসলিম মহিলারা ঢেলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার মোদী যত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, উত্তরপ্রদেশে ততই পাল্লা ভারী হয়েছে অখিলেশ যাদবের। বিহারেও একই অবস্থা। ওই রাজ্যে নীতীশ কুমারের সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার ভাবমূর্তি যদি কাজ করে, তবেই ভাল ফলের আশা করছে বিজেপি। তা না হলে যাদব ও মুসলিম সমীকরণে এ বার আরজেডির কাছে একাধিক আসন হারাতে চলেছে এনডিএ। পশ্চিমবঙ্গেও বড় সংখ্যক পসমন্দা সমাজের মানুষ রয়েছেন। সম্প্রতি রাজ্যের দেওয়া ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করেছে হাই কোর্ট। এর পর মোদী পশ্চিমবঙ্গে এসে বলে চলেছেন, মুসলিমদের এখানে ভুয়ো ওবিসি শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। আদালতের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বও।
বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের নেতারা মনে করছেন, বিজেপি উন্নয়নের ছবি দেখিয়ে ভোটের প্রচার করলে তাদের মুসলিম ভোট পাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু যে ভাবে এ বারের প্রচারে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করা হয়েছে, তাতে ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু সমাজেরও বড় অংশ বিজেপির উপরে অসন্তুষ্ট। ফলে বিজেপির এ বার ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে বলেই ‘ইন্ডিয়া’ নিশ্চিত।