“তাঁর অতি প্রিয় মানুষদেরও তিনি ছাড়েননি। এমনকি পুলিশের এবং সরকারি ব্যবস্থাপনাতে ঘুষ খাওয়া আর অন্যান্য দুর্নীতি নিয়েও তিনি অসংকোচে মুখ খুলেছেন। ফিল্মে-নাটকে ছাড়া কলকাতা কেন, কোনও দেশের পুলিশই বোধ হয় এমন পুলিশ কমিশনার দেখেনি।” তুষার তালুকদারের ‘আমার যা কিছু’-র ভূমিকায় এ কথা লিখেছেন প্রবীন শিক্ষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার। আবার মহাশ্বেতা দেবী তুষারবাবু সম্পর্কে লিখেছেন, “তিনি লিখুন। সারা বছর ধরে লিখুন। আমরা একটা মস্তিষ্কগ্রাহ্য নির্মোহ লেখা পড়তে চাই।“
গত শতকের ৮০-৯০ দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় টানা ‘পুলিশ বিট’ করার সুবাদে নানা সময় পদস্থ অনেক আইপিএস অফিসারের সংস্পর্শে এসেছি। তাঁদের অনেকে চলে গিয়েছেন চিরকালের মত। জীবিত প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের মধ্যে তুষারবাবু এক কথায় অনন্য। প্রকৃতই বর্ণময়। সব কিছু মিলিয়ে একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি। প্রায় ৮৪ বছরের এই প্রাক্তন পুলিশকর্তার ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ। সাক্ষাৎকার নিয়েছি ২৭-৪-২০২৩।
———————————————————
প্রশ্ন ১- বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার পরিবারের যোগসূত্র কী?
— আমাদের দেশ ছিল ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রামে। মায়ের দেশ ছিল শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ মহকুমায়। সে সময় বৈবাহিক সূত্রে ময়মনসিংহ-শ্রীহট্টের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাবা ছিলেন পরিবারের প্রথম কলেজ পড়ুয়া। কাজ পেয়েছিলেন মিলিটারি টেস্ট অডিট বিভাগে। পরে যেটা চিহ্নিত হয় ডিফেন্স অডিট হিসাবে। বদলির চাকরির সুবাদে আমাদের পাঁচ ভাইয়ের জন্ম ভারতের পাঁচ শহরে। আমার জন্ম পুনায় (পুনে), ১৯৩৯-এর ১ সেপ্টেম্বর।
প্রশ্ন ২- পূর্ববঙ্গের কোনও স্মৃতি মনে আছে?
— আমার বাবা কলকাতার কাঁকুলিয়া রোডে সিআইটি-র কাছ থেকে প্লট কিনে বাড়ি করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল পাঁচ পুত্র এখানে থেকে পড়াশোনা করবে। আমার একেবারে বাল্যকালে, ১৯৪০ নাগাদ বাবা মারা গেলেন। ১৯৪২-এ মহাযুদ্ধের আতঙ্কে অনেকে নিরাপদ স্থানে যেতে শুরু করলেন। মা নগদ অর্থ, তাঁর অলঙ্কার আর আমাদের ছোটছোট পাঁচ ভাইকে নিয়ে ময়মনসিংহের বাড়িতে গেলেন। কিন্তু আমরা থাকব না, চলে যাব জেনে আত্মীয়রা সেই টাকা-গয়না কার্যত লুঠ করে নিলেন। অবশ্যই সেটা সুখস্মৃতি নয়।
প্রশ্ন ৩- কী পরিস্থিতিতে চলে এলেন?
— খুব সামান্যই মনে আছে। একটা হিন্দুবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল স্থানীয় মুসলমানদের মনে। তাঁরা অনেকেই (যাঁরা আমাদের ফাইফরমায়েস খাটতেন) মা-কে বললেন কলকাতায় ফিরে যেতে। না গেলে প্রাণহানির আশঙ্কার কথাও ওঁরা মাকে বোঝালেন। রাতের অন্ধকারে তাঁদের সহায়তা নিয়েই মা আমাদের হাত ধরে ফের চলে এলেন কলকাতায়।
প্রশ্ন ৪- উদ্বাস্তুদের কথা কিছু মনে পড়ে?
— ওরা তো প্রায় তখন থেকেই আসতে শুরু করেছে। আমাদের বাড়িতে আসত ‘মা একটু ভাতের ফ্যান দাও’ বলে কী কাতর প্রার্থনা! একদিন রাতে এরকম এল একদল। মা কিছু রুটি আমার হাতে একটা কাগজে মুড়ে দিয়ে বলল, যা দিয়ে আয়। আমি ওদের কাছে যাওয়ামাত্র ১০-১২টা হাত এগিয়ে এল। আধো অন্ধকারে ভয় পেয়ে আমি ওদের হাতে না দিয়ে রুটি মেঝেতে ফেলে দিলাম। ট্রমাটিক মনে হয়েছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে মা-কে গিয়ে বললাম, “মা, আমার ভয় করছে!“ এর পর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দলে দলে অসহায় শরনার্থীরা এসেছে ভারতে। ওদের বেশির ভাগই ছিলেন নানা শিবিরে। অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
তবে, দেশভাগের পরেই উদ্বাস্তু শব্দটার সঙ্গে আমাদের পরিচয়। স্কুলে রিফিউজি বন্ধু অনেক ছিল। তাদের আত্মীয়স্বজন কেউ কেউ হকারি করতেন। ভালোবেসে নয়, বাধ্য হয়ে। তারপর থেকেই অনেক ফাঁকা জায়গা রিফিউজিরা জবরদখল করে কলোনি তৈরি করেন। তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই খুবই সংগত—মা-মাসিরা এমনই আলোচনা করতেন। তা সত্ত্বেও, চোখে পড়ত ছিন্নমূল অসহায় মানুষদের অপরিসীম দুর্দশা। আমরা খুব বাল্যকাল থেকেই বুঝতে পেরেছি, এই দুর্দশা এঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এঁরা কেউই স্বেচ্ছায় ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতার রাস্তায় খাবারের খোঁজে আসেননি।
প্রশ্ন ৬- বাংলাদেশ স্বাধীন হল। এ সময়কার কোনও স্মৃতি?
— ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ওখানে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রায় শেষ। এর ফলে অনেক প্রশাসনিক সমস্যা হচ্ছে ও দেশে। সে জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল বেশ কিছু অফিসারকে ওদের দেশে ডেপুটেশনে পাঠাতে। সরকার এই প্রস্তাবে রাজি হয়। সেইমতো আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের একটা তালিকা তৈরি হয়। শুনলাম আমাকেও বাংলাদেশে যেতে হবে। এ-কথা শুনেই আমি চমকে উঠলাম। বাংলাদেশে পোস্টিং! কী ব্যাপার, সেখানে কী কাজ করতে হবে? বাংলাদেশ যদিও আমার পিতৃপুরুষের দেশ, কিন্তু সে-দেশের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয়ই নেই। যদিও এক ওপরওয়ালা বললেন, “এমন কিছু ব্যাপার নয়। যে-কাজ এখানে করছ, সেই কাজই ওখানে করতে হবে। কোনও একটি জেলায় এসপি হিসেবে কাজ করতে হবে। এখান থেকে কিছু আইএএস এবং আইপিএস অফিসারকে বাছাই করা হয়েছে, তার মধ্যে তুমিও আছ। আর হ্যাঁ, ওখানে টাকাপয়সার দিক থেকে তোমার অনেক সুবিধা হবে। অনেক বেশি টাকাপয়সা পাবে।“
তার আগে আমাদের কিছু ব্রিফিং হল রাজভবনে।
রোজই রাজভবনে যেতে হত। সেখানে শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, অন্য রাজ্যের বাঙালি আইএএস, আইপিএস – সব মিলিয়ে আমরা প্রায় ৩০ জন হাজির। আমাদের খুব সিরিয়াস ব্রিফিং আরম্ভ হল। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব, বিদেশ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব থেকে আরম্ভ করে কেউ আর আসতে বাকি রইলেন না। সবাই এসে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, আমাদের কী কাজ করতে হবে, কীভাবে করতে হবে- এসব বোঝালেন। আমাদের মধ্যে একটু বয়স্ক অফিসাররা নানা ওজর-আপত্তি তুলতেন। আমার মনে কোনও প্রশ্ন ছিল না। একটা অন্য ধরনের আনন্দ, উত্তেজনার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, আমাকে কোনও জেলায় পোস্টিং দিতে চাইলে বলব ময়মনসিংহেই দেওয়া হোক। সেখানেই আমার পিতৃপুরুষের আদি নিবাস।
কিন্তু এতসব জল্পনা-কল্পনা, প্রস্তুতিতে জল ঢেলে গোটা পরিকল্পনাটাই ভারত সরকারকে বাতিল করতে হল। পাকিস্তান চীনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই পরিকল্পনার কথা তুলে খুবই হইচই বাধাল। তাদের বক্তব্য, সেনা প্রত্যাহার করে ভারত সরকার অন্যভাবে নিজের শাসন জারি করতে চায় বাংলাদেশে।
প্রশ্ন ৬- এর পর আর বাংলাদেশে যাননি?
— হ্যাঁ। বাংলাদেশ স্বাধীন হল। ১৯৭৩-’৭৪এ আমি তখন পুলিশ অফিসার। ট্রেনে-বাসে করে গেলাম পিতৃভূমি দেখতে। দেখলাম শৈশবে দেখা প্রায় সব স্মৃতি মুছে গেছে। আত্মীয়রা নেই। জমিজমা সব দখল হয়ে গেছে। বাড়িঘর ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে নতুন ঘর।
প্রশ্ন ৭- এই যে এত কোটি কোটি হিন্দু ভিটে ছেড়ে ওপার বাংলা থেকে ভারতে চলে এলেন, কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
— দেশভাগ, হিন্দুদের এভাবে দেশান্তরী হওয়া, এসবের জন্য তো হিন্দুরাই দায়ী! বছরের পর বছর হিন্দুরা মুসলমানদের অচ্ছুৎ করে রেখেছে। এই মুসলমানরা আরব থেকে আসেনি। স্থানীয় বাসিন্দা এরা। এদের ছায়া মারাত না হিন্দুরা। এই অস্পৃশ্যতা, বর্ণাশ্রম ওরা মেনে নিতে পারেনি। এর জন্য প্রবল ক্রোধ জমে ছিল ওদের মনে। ওদের মনে হয়েছিল একমাত্র উচ্চবর্ণের দাসত্ব করাই বুঝি ওদের ভবিতব্য। অথচ, মুসলমানরা নিজেরা বলত, আমরা তো সবাই এক বলে মনে করি! এই যুগসঞ্চিত ক্রোধ একটা নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করল। দেশভাগও অনেকটা এর জন্যই। জিন্না পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করলেন। স্বাধীনতা পেয়ে শান্তিতে ক্ষমতা ভোগ করবেন ভেবে হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রনায়কদের একটা বড় অংশ এই দেশভাগের দাবি সমর্থন করলেন। হিন্দু-মুসলমান হয়ে উঠেছিল দাবার ঘুঁটি।
প্রশ্ন ৮- কিন্তু অনেকে মনে করেন যেভাবে পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের উৎখাত করা হয়েছে, তা ক্ষমাহীন অপরাধ। আপনি কি সেই দীর্ঘ ঘটনাবলী আর হিন্দুদের অস্পৃশ্যতা এক নিক্তিতে মাপবেন?
— না, প্রতিক্রিয়া কখনও ক্রিয়ার পরিমাপে হয় না। যুগসঞ্চিত ক্ষোভ যুক্তি মানে না। মুসলমানদের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার মধ্যে তাই আমি খুব দোষ দেখি না।
প্রশ্ন ৯- আপনি নিজে হিন্দু?
— আমি মানবতার পূজারি। (চেয়ারের ডান পাশে টেবিলের ওপর রাখা পেতলের বুদ্ধমূর্তি দেখিয়ে বললেন), উনি বলেছেন সবচেয়ে প্রয়োজন ক্ষুধার অন্ন। মানুষের ধর্ম মানবধর্ম। অন্য তকমা লাগালেই বিপদ। এই ধর্মই হচ্ছে যত নষ্টের, যত কষ্টের কারণ।
(সাক্ষাৎকারের কিছুটা তুষারবাবুর লেখা ‘আমার যা কিছু’-র অংশবিশেষ)।