পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৯০) বিকে দাস লেনের লক্ষ্মীভিলা

সোহেল মামুদ পথে প্রান্তরে ফেসবুক গ্রুপে লিখেছেন, “অযত্নে অবহেলায়, দখলে, হামলায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রত্নতত্ব নিদর্শনগুলোর নিয়তি। কিন্তু ব্যতিক্রমও কখনো কখনো ঘটে। দখলের রাহুগ্রাস এড়িয়ে বেঁচে থাকা তেমনই সৌভাগ্যবান একটি স্থাপনা ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকার বিকে দাস লেনের লক্ষ্মীভিলা নামক নান্দনিক স্থাপনাটি।

১৯১১ সনে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার তৎকালীন ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক বসন্ত কুমার দাস। দেশ ভাগের সময় বসন্ত দাসের পরিবার দেশ ত্যাগ করেন। তিনি সম্পত্তিটি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা একটি মুসলমান পরিবারের সঙ্গে ওই পরিবারের ভারতের সম্পত্তির বিনিময় হস্তান্তর করেন। সময়ের আবর্তে বাড়িটিতে দেশ ভাগের ফলে ভারত থেকে আগত পরিবার বসবাস করতে থাকে।

বয়সের ভারে ক্রমেই ভবনটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সম্প্রতি লক্ষ্মভিলা অলক্ষ্মীর রাহু গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়েছে। সংস্কারের ছোঁয়ায় সে ফিরে পেয়েছে আপন প্রাণ। লক্ষ্মীভিলার চোখ ধাঁধানো রূপ আপনাকে ফরাসগঞ্জের যৌবনের দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।


ছবি: সংস্কারের কাজ চলছে।

আহা! ঠিক এমনি রূপে যদি ফিরে আসে পুরানো ঢাকার প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া রূপলাল হাউজ এবং শঙ্খনিধি হাউজ।”

‘দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা’ (১৮-৫-২০২২)-তে শেহরিন আমিন সুপ্তি, রাফিয়া মামুদ প্রাত লিখেছেন, “১৭৪০ সালের দিকে ফরাশগঞ্জের এই এলাকাতেই স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল এদেশে ব্যবসা করতে আসা ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি নাগরিকরা। সেই ফরাসি থেকেই ‘ফরাস’ আর বাজারের প্রতিশব্দ ‘গঞ্জ’ মিলে এলাকার নামকরণ হয়েছিল ফরাশগঞ্জ। এখানকার প্রাচীন বাড়িগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে তাই ফরাসি ঐতিহ্যের ছাপ লক্ষণীয়। বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে থাকা ফরাশগঞ্জের রাস্তার দুই ধারে যাবতীয় মশলা আর শুকনো বাজারের আড়ত। আলু, পেঁয়াজ, হলুদের বস্তার ঝাঁঝালো গন্ধ আর শুকনো মরিচের ঝাল নাকে-মুখে এসে লাগছিল হাঁটতে হাঁটতেই। পড়ন্ত দুপুর বেলাতেও পিকআপ ভ্যানে মালামাল তোলার ব্যস্ততায় রাস্তা জুড়ে ছিল জ্যাম। রাস্তার নাম বি কে দাস লেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বসন্ত কুমার দাস নামের এক ব্যবসায়ী বরিশাল থেকে এসে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এই এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আবাস। ব্যবসায় প্রসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরোপকারী হিসেবেও ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নামডাক। পরবর্তীতে এই রাস্তার নামকরণও হয় তার নামেই।

বি কে দাস লেনের জনারণ্যের এক পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লালকুঠি, রূপলাল হাউজ, বিবি কা রওজার মতো স্থাপনাগুলো পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চোখে পড়ে ঝুলন্ত বারান্দাওয়ালা হলদেটে সেই বাড়ি। দরজা, জানালা বন্ধ। বাড়ির আঙ্গিনায় নিচু রডের বেড়া দিয়ে আগলানো। সামনের ছোট্ট গেটও তালাবদ্ধ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, দীর্ঘদিন ধরেই এখানে আবাস নেই কারো।

মূল ফটক দিয়ে যেহেতু ঢোকার উপায় নেই, তাই পাশের ছোট্ট লোহার গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলাম বাড়ির ভেতরে। কোনো সাড়াশব্দ নেই, চারদিকে ঘাসের জঙ্গল, সামনে বসবাসযোগ্য কিছু ঘর দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম ঘরগুলোর দিকে। স্যাঁতস্যাঁতে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হলেও, মানুষের বসতি যে আছে তা বুঝলাম দরজার বাইরে তিন জোড়া স্যান্ডেল দেখে। গেটের থেকে অনেকখানি ভেতরে, বাম পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর ডান দিকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা। ভয়ে ভয়ে কড়া নাড়লাম দরজায়।

অভিভাবকহীনতায় ভুগছে বাড়িটি। ছাদ থেকে প্রায়ই পলেস্তারা খসে পড়ে, বর্ষার মরসুমে ভিজে ওঠে ছাদ আর দেয়াল। মূল মালিক মারা যাওয়ার পর তার তিন ছেলেই দেখাশোনা করতেন এটি। বড় ছেলে প্রতি শুক্রবার এসে নামাজ পড়তেন বাড়ির সামনের মসজিদে। বাড়ির খুঁটিনাটি সব কিছুর তদারকি করতেন নিজেই। বর্তমানে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাই মালিকপক্ষের কেউ আর সরাসরি এসে দেখাশোনা করতে পারছেন না। কেয়ারটেকার আর ম্যানেজারের হাতেই ন্যস্ত গোটা বাড়ির দায়ভার।

বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে এক বছরেরও কম সময় ধরে থাকা ম্যানেজার মোস্তাক হোসেন জানান, এর আগে প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁর শ্বশুর। পাকিস্তান আমলে ব্যারিস্টার আসরারুল হোসেন এই বাড়ির মালিকানা পান। প্রায় দুই দশক আগে আসরারুল হোসেন মারা যান। এরপর তার বড় ছেলে আলতাফুল হোসেন নিয়মিত এসে দেখাশোনা করতেন বাড়ির। তিনি অসুস্থ থাকায় বাড়ির সব দায়িত্ব ম্যানেজারের উপরই বর্তায়। আসরারুলের মেজ ছেলে বিশিষ্ট আইনজীবী কুইন কাউন্সিলের সদস্য আজমালুল হোসেন লন্ডনে থাকেন। ছোট ছেলে সম্পর্কে তিনি আর কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

পুরো বি কে দাস লেন জুড়ে এমন বহু নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর কোনোটি পরিচিত ‘জিউ মন্দির’ নামে, কোনোটির নাম বড় বাড়ি, কোনোটির নাম মঙ্গলালয়, কোনোটি আবার পুতুল বাড়ি নামেও পরিচিত।  অধিকাংশই ভগ্নদশা। এই বাড়িগুলোর নাম যেভাবে লোকেমুখে ছড়িয়ে আছে, ততোটা কিন্তু ছড়িয়ে নেই এগুলোর ইতিহাস। বাড়িগুলোর প্রকৃত মালিক বা নির্মাতা কে ছিলেন, সে বিষয়ে এলাকার মানুষদের কাছ থেকে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

অনিন্দ্য সুন্দর, নান্দনিক স্থাপত্যের এই করুণ অবস্থাই বলে দিচ্ছে বাড়িগুলোর প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। নেই কোনো ইতিহাস চর্চা, নেই এই বাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করার কোনো প্রচেষ্টা।

সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.