দল গুরুত্ব না দিলে রাজনীতিকে ‘টা টা বাই বাই’ বলে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন বিজেপির অভিমানী নেতা দিলীপ ঘোষ। সেই হুঁশিয়ারির পরে বেশ কয়েকটা মাস কেটে গেলেও দিলীপ দলে সে ভাবে কোনও বাড়তি গুরুত্ব পাননি। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি নিয়মিত হলেও রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব রয়েই গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মেদিনীপুর উপনির্বাচনে দিলীপ কি পদ্মের প্রার্থী হতে পারেন? এমন জল্পনা রয়েছে বিজেপিতে। কিন্তু দিলীপের মনের কথা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, যেখানে সাংসদ ছিলেন, সেখানে বিধায়ক হওয়ার লড়াইকে রাজনৈতিক ভাবে ‘অবনমন’ দেখছেন দিলীপ। সুতরাং, উপনির্বাচনে লড়াইয়ের কোনও প্রশ্নই নেই।
মেদিনীপুর জেলা বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য দিলীপকেই চান। অখণ্ড মেদিনীপুরের ছেলে দিলীপের ভোট রাজনীতিতে পা রাখা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকেই। প্রথমে মেদিনীপুর লোকসভা আসনের অন্তর্গত খড়্গপুর সদর থেকে বিধায়ক এবং তার পরে সোজা সাংসদে। ২০১৯ সালে নিজে জিতেছেন, দলকেও জিতিয়েছেন ১৮ আসনে। কিন্তু ২০২৪-এর দিল্লিবাড়ির লড়াই থমকে দিয়েছে দিলীপের জয়ের ধারা। শেষবেলায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে। যদিও সেটি বিজেপির জেতা আসন ছিল, তবু মেদিনীপুরের থেকে অনেক অনেক কম ব্যবধানে। লোকসভার ফল বলে দিয়েছে, মেদিনীপুর, বর্ধমান-দুর্গাপুর দুই আসনই হাতছাড়া বিজেপির।
২০১৯ সালে যে আসনে দিলীপ প্রায় ৮৯ হাজার ভোটে জিতেছিলেন, সেটিতেই বিজেপি প্রার্থী হারেন ২৭ হাজারের বেশি ভোটে। বিধায়ক থেকে সাংসদ হয়ে যান তৃণমূলের জুন মালিয়া। আর তাতেই উপনির্বাচন মেদিনীপুর বিধানসভা আসনে।
দিলীপ যখন মেদিনীপুর লোকসভা আসন জিতেছিলেন তখন মেদিনীপুর বিধানসভায় বিজেপি এগিয়ে ছিল প্রায় ১৭ হাজার ভোটে। আর গত লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল পিছিয়ে যান দু’হাজারের বেশি ভোটে। মাঝে ২০২১ সালে তৃণমূলের জুন জিতেছিলেন ২৪,৩৯৭ ভোটে। ফলে এই আসনের উপনির্বাচনে যে বিজেপির লড়াই যে খুব সহজ তা-ও নয়। এই পরিস্থিতির উল্লেখ করে দিলীপ-ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত রাজ্য বিজেপির এক প্রাক্তন নেতা বলেন, ‘‘গত লোকসভা নির্বাচনে দিলীপদার আসন বদল না করলে বিজেপির হাতে থাকত মেদিনীপুর। উপনির্বাচনের প্রয়োজনও থাকত না।’’ তিনি এমন প্রশ্নও তোলেন যে, ‘‘জুন মালিয়াকে হারানোর কথা ছিল দিলীপদার। এখন জুন সাংসদ হয়েছেন বলে উপনির্বাচনে লড়তে হবে দিলীপদাকে? এটা দল ভাবে কী করে?’’
মেদিনীপুর জেলা বিজেপির পক্ষে দিলীপের নাম রাজ্য নেতৃত্বকে পাঠানো হয়েছে বলেই জানা গিয়েছে। তবে রাজ্য বিজেপি সেই নাম দিল্লিকে দিয়েছে কি না সেটা জানা নেই মেদিনীপুর নেতৃত্বের। একই সঙ্গে বিজেপি সূত্রে এটা জানা গিয়েছে যে, মেদিনীপুরের উপনির্বাচনে দিলীপকে প্রার্থী করার ব্যাপারে রাজ্যের কোনও নেতা প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কথাও বলেননি। আসলে দিলীপ আদৌ রাজি হবেন কি না তা নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন। দিলীপের ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, রাজ্য সভাপতি, সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি, সাংসদ থাকার পরে উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অর্থ রাজনৈতিক ‘অবনমন’। সেটা ভেবেই দিলীপ ইতিমধ্যে মেদিনীপুর জেলার যে নেতারা তাঁকে প্রার্থী পেতে চান তাঁদের ‘না’ বলে দিয়েছেন বলেও দাবি ঘনিষ্ঠদের।
দিলীপ রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে যখন বিধানসভায় গিয়েছিলেন তখন সেখানে বিজেপি বিরোধী দলের মর্যাদা না পেলেও তিনিই ছিলেন দলের নেতা। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে বিরোধী দলনেতা হয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। আর তার পর থেকে বারংবার দিলীপ-শুভেন্দু ‘মধুর’ সম্পর্ক প্রকাশ্যে এসেছে। এখনও দলীয় কর্মসূচিতে দুই নেতাকে প্রকাশ্যে পাশাপাশি বসতে দেখা গেলেও তাঁদের বাস্তব ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা দলের সকলেরই জানা। সে দিক থেকেও দিলীপের পক্ষে মেদিনীপুরে প্রার্থী হওয়াটা সহজ নয়। কারণ, জিতে গেলে তাঁকে বিধানসভায় শুভেন্দুর নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে। দিলীপ অবশ্য এ সব নিয়ে মুখ খুলতেই রাজি নন। তবে ঘনিষ্ঠদের এটা জানিয়েছেন যে, মেদিনীপুরের উপনির্বাচনে দল চাইলে তিনি প্রচারে যাবেন। প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাজও করবেন। তবে প্রার্থী হবেন না। দিলীপ এটা বলছেন বটে, তবে এর পরেও দিল্লি তাঁর নাম ঘোষণা করে দিলে ‘না’ বলে নতুন করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরাগাভাজন হতে চাইবেন কি তিনি? লোকসভা নির্বাচনে যেমন আসনবদলে ‘না’ বলেও তাঁকে শেষ পর্যন্ত ঢোঁক গিলতে হয়েছিল। এই প্রশ্নের জবাবে দিলীপের ঘনিষ্ঠেরা ‘দাদা’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত। দিলীপ আবার রাজ্য সভাপতি হবেন বলে যাঁরা ক’দিন আগেও প্রচার করছিলেন তাঁদেরই বক্তব্য, জোর করলে বুঝতে হবে দল দিলীপদাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে।