১৯৪২ সালের ৮ ই আগষ্ট, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ভারতছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজকে ভারত থেকে সরিয়ে দেওয়া। শ্লোগান ছিল, ‘ইংরেজ, ভারতকো ছোড়ো’ আর ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’। Do or die. আসমুদ্র হিমাচলের সমস্ত ভারতবাসী প্রায় দু’শ বছরের পরাধীনতার ক্ষোভে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন, এবার আর কোনো আপস নয়। সরাসরি ইংরেজদের ভারত ছাড়া করার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়কল্প সমস্ত ভারতীয়। অহিংস, সন্ত্রাসবাদী — দুই পথেই চলল সংগ্রাম। অর্থাৎ আমৃত্যু স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হল সর্বভারতীয় স্তরে।
ইংরেজকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করার যে ডাক গান্ধীজী দিলেন তা বাংলায় এসে পৌঁছালো। বাংলার মানুষদের মধ্যে গান্ধীজীর ডাকে যারা সাড়া দিলেন তাদের অন্যতম হলেন বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা। বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমার হোগলা গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৬৯ সালে। মাতঙ্গিনী হাজরার জন্মসালটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ১৮৭০ সালের ১৯ শে অক্টোবর তাঁর জন্ম। তাঁর জন্ম ১৮৭০ সালের ১৯ শে অক্টোবর না ১৮৭০/১৮৬৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর — এটা নিয়ে বিবিধ মতামত পাওয়া যাচ্ছে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে এই নারী প্রথাগত কোনো শিক্ষা পাননি।
ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় বাল্যকালে। কোনো সন্তান সন্ততি ছিল না, মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কালে মাতঙ্গিনী হাজরা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন গান্ধীবাদী। এজন্য স্থানীয় মানুষ তাঁকে সম্মান দিয়ে ‘গান্ধীবুড়ি’ বলে ডাকতেন। ১৯৩২ সালে আইন আমান্য আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। লবণ আইন ভঙ্গ করে ব্রিটিশদের দ্বারা কারারুদ্ধ হন। মুক্তিলাভের পরেও লবণ-কর বন্ধ করার জন্য তিনি প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়ে যান। ফলে ব্রিটিশরা তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে এবং ছ’মাসের জন্য বহরমপুরে প্রেরণ করে। কারামুক্তির পর সক্রিয়ভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করে, তিনি নিজের হাতে চরকা কাটতে শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে কংগ্রেসের আঞ্চলিক সম্মেলন হয় শ্রীরামপুরে। এখানে মাতঙ্গিনী হাজরা অংশগ্রহণ করেন। শেষে ব্রিটিশ পুলিশ লাঠিচার্জ করে, মাতঙ্গিনী হাজরা গুরুতরভাবে আহত হন।
বেয়াল্লিশের ভারতছাড়ো আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস বিভিন্ন আঞ্চলিক থানাগুলি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ৭২ বছর বয়সের গান্ধীবুড়ি আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতার আন্দোলনে। প্রায় ছয় হাজার বিপ্লবী তাঁর নেতৃত্বে একটি মিছিল করে; উদ্দেশ্য তমলুক থানা দখল। শহরের প্রান্তে যখন বিশাল মিছিল এসে পৌছায় ১৪৪ ধারা অনুসারে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ হতে বলে। বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী এগিয়ে চলেন সদর্পে। আবেদন করেন জনগণকে গুলি না চালাতে, তখনি প্রথম গুলি এসে আঘাত করে তাঁকে। তাতেও পিছিয়ে যাননি মাতঙ্গিনী। ‘বিপ্লবী’ সংবাদপত্রের খবর অনুসারে, সমান্তরাল তমলুক জাতীয় সরকারের বক্তব্য ছিল — মাতঙ্গিনী ক্রিমিনাল কোর্ট বিল্ডিং-এর উত্তর দিক থেকে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, প্রথম গুলি চলার পরেও, তিরঙ্গা পতাকা হাতে নিয়ে তিনি সকল বিপ্লবীকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যান, ব্রিটিশ পুলিশের দিক থেকে তিনবার গুলি চালানো হয়। তবুও তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন, কপালে ক্ষত, দুই হাতে ক্ষত তথাপি তেরঙ্গা পতাকা এতটুকু ঝুঁকে যায় নি। শেষ বারের মত ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে পতাকা উঁচু রেখে নশ্বরদেহ ত্যাগ করেন দিব্য আত্মা।
মনে পড়ে ১৯১৯ সালের কথা। নিষ্পাপ নিরপরাধী কতকগুলি মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী। নিঃশেষে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় মানুষগুলি। ঘটনাটি কুখ্যাত হয়ে আছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড রূপে। গত ২০১৯-এ এই ঘটনার শতবর্ষ পূর্তি ছিল, আমরা বেদনার্ত চিত্তে স্মৃতিচারণ করেছি। মাতঙ্গিনী হাজরাকেও ১৯৪২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর নিঃশেষে শেষ করে দেওয়া হয় একের পর এক গুলি চালিয়ে। অত্যাচারী পররাষ্ট্রগ্রাসী গোষ্ঠীরা এমনি হয় — নৃশংস নির্দয়।
আজ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, বিশ্বায়নের পৃথিবীতে আধুনিক মানুষ দাবি করেন রাষ্ট্রহীনতার। মনে হয়, এই মানুষগুলোর স্বদেশপ্রেম কী কোনো আবেদনই রাখে না তাদের চিত্তে? শুধু দশের জন্য, দেশের জন্য আত্মবলিদানের এই সত্য ইতিহাসগুলি কী একদিন স্বার্থান্বেষী আধুনিক মানুষের কাছে গল্প কাহিনী বলে মনে হবে? বাংলার প্রতিটি শিশু কী শ্রদ্ধা করতে শিখবে বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরাকে? যদি এই শ্রদ্ধাবোধ আমাদের মধ্যে না গড়ে ওঠে তাহলে বলব, ভারতবাসী এই ঐশী পূর্বপ্রজন্ম পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। আশাবাদী হতে ইচ্ছা করে। তাই বলি, সারা ভারত মাতঙ্গিনী হাজরার মত বীরাঙ্গনা নারীকে কখনো ভুলবে না, ভুলতে পারে না।
অস্মিতা চক্রবর্তী