প্রাথমিকে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বহাল রেখেছে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। খারিজ করে দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ। বুধবার বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, দুর্নীতি হয়েছে। তবে এত শিক্ষকের চাকরি বাতিল করে দেওয়া যাবে না। ৯ বছর ধরে তাঁরা চাকরি করেছেন। চাকরি বাতিল করলে তাঁদের পরিবারের উপরেও প্রভাব পড়বে। মূলত মানবিক কারণেই চাকরি বাতিলের নির্দেশ খারিজ করেছে আদালত। ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ে তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

অভিজিতের রায়ের মূল কথাগুলি বুধবারের রায়ের কপিতে উল্লেখ করেছে ডিভিশন বেঞ্চ—
- কোনও অ্যাপটিটিউড টেস্ট (দক্ষতা পরীক্ষা) নেওয়া হয়নি।
- ইন্টারভিউ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের কোনও আনুষ্ঠানিক নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। কী ভাবে অ্যাপটিটিউড টেস্টে নম্বর দিতে হবে, তার কোনও নির্দেশিকাও ছিল না।
- অ্যাপটিটিউড টেস্টে দেওয়া নম্বর সম্পূর্ণ বেআইনি। আদালত-সহ সকলকে ধোঁকা দেওয়ার মিথ্যা প্রক্রিয়া।
- ইন্টারভিউয়ের মূল্যায়ন ছিল সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। এর নেপথ্যে বহিরাগত কারণ রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সিবিআই ও ইডির তদন্তে।
- সংরক্ষিত শ্রেণির এমন অনেক প্রার্থী ছিলেন, যাঁরা সাধারণ শ্রেণির প্রার্থীদের তুলনায় বেশি নম্বর পেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও তাঁদের সাধারণ তালিকায় জায়গা দেওয়া হয়নি।
- নিয়োগের জন্য বোর্ড কোনও সিলেকশন কমিটি গঠনই করেনি। বরং একটি বাইরের সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং তার সভাপতি-সহ আধিকারিকেরা একটি ক্লাব চালানোর মতো করে পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়া পরিচালনা করেছিলেন। যাঁদের টাকা ছিল, তাঁদের কাছে শিক্ষকের চাকরি বিক্রি করা হয়েছে।
- পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির দুর্গন্ধ পাওয়া গিয়েছে।
রায়ের প্রতিলিপিতে আদালত জানিয়েছে, ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল এই মামলায় জড়িত, যাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে এত বছর ধরে পরিষেবা দিয়ে আসছেন। কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ভাবে অপরাধ বা অন্যায়ের অভিযোগ নেই। কিন্তু অভিযোগ, বোর্ড দুর্নীতি করেছে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম মেনে নিয়োগ করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে জ়িরো টলারেন্স নীতির অনুসরণ প্রয়োজন কি না, এই ধরনের নিয়োগে হস্তক্ষেপ করা অন্যায় কি না, তা আমাদের বিশেষ ভাবে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য করেছে।

ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য
- আদালত সবসময় চায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা বজায় থাকুক। যদি কোনও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এমন ধরনের ব্যাপক অনিয়ম প্রমাণিত হয়, যাতে পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আদালত পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে পারে।
- ব্যাপক অনিয়ম বলতে বোঝায়, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম বা জালিয়াতি হয়েছে। এমন অনিয়ম যেখানে অনেক প্রার্থী সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু আদালতের উপর এই দায়িত্ব আরোপ করা যায় না যে, তারা অতিরিক্ত অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিটি সম্ভাবনা, প্রতিটি বিকল্প ব্যাখ্যা, প্রত্যেক কল্পিত পরিস্থিতি এক এক করে খুঁজে বার করে সব ব্যাখ্যা বাতিল করবে।
- ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনও ইন্টারভিউ এবং অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এর আইনগত এবং তথ্যগত ব্যাখ্যা মামলাকারীরা স্পষ্ট করতে পারেননি।
- ন্যায়বিচারের সময় আদালতকে একটি সীমার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। আদালত নিজের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী, নতুন নতুন নীতি তৈরি করে নিয়োগপ্রক্রিয়া বদল করতে পারে না। সব নিয়োগ বাতিল করার জন্য আদালতের সামনে প্রমাণ-সহ একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যেখানে বলা সম্ভব পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক, সর্বজনীন অনিয়ম হয়েছে। এই মামলার তথ্য থেকে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলা যাচ্ছে না।

- কয়েক জন ব্যর্থ চাকরিপ্রার্থী নিজেদের অসন্তোষের কারণে এ ভাবে ৩২ হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার সুযোগ পেতে পারেন না। এই ভাবে চাকরি বাতিল করলে অনেক নির্দোষ, সৎ শিক্ষককে অকারণে অপমান, লজ্জা ও কলঙ্ক সহ্য করতে হবে। তা ছাড়া, তদন্ত এখনও চলছে। চাকরি বাতিল না-করার সেটাও অন্যতম কারণ।
- তদন্তে কোথাও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যে, যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে, মোট ২৬৪ জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। তাঁদের অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছিল। তদন্তে এই ২৬৪ জনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। আরও ৯৬ জন প্রার্থী ন্যূনতম যোগ্যতার নম্বর পাননি, তবুও তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই কিছু প্রার্থীর সমস্যা রয়েছে বলেই, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘ভুয়ো’ বলা যায় না। ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে একযোগে বাতিল করার কোনও আইনি ভিত্তি নেই।
- নতুন পরীক্ষার নির্দেশ দিলে তার প্রভাব সব শিক্ষকের উপর সমান ভাবে পড়বে না। প্রায় ৯ বছর পরে পুনরায় পরীক্ষার নির্দেশ দিলে প্রকৃতপক্ষে অন্যায় ও অযৌক্তিক পরিস্থিতি তৈরি হবে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। ইতিমধ্যে তাঁরা ৯ বছর চাকরি করেছেন। নিয়োগের সময় যাঁর ১৮ বছর বয়স ছিল, এখন তিনি ২৭। যাঁর সে সময় ৪০ বছর বয়স ছিল, এখন তিনি ৪৯। হঠাৎ চাকরি কেড়ে নেওয়া হলে শিক্ষককে এবং তাঁর পরিবারকে ভোগান্তির শিকার হতে হবে। এ ভাবে চাকরি হারালে ওই শিক্ষকদের অস্তিত্বসঙ্কট দেখা দেবে। তাই চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্তকে আমরা সমর্থন করছি না।
কী বললেন অভিজিৎ
প্রাথমিকে ৩২ হাজার চাকরি সংক্রান্ত কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় শুনে এসএসসি-র মামলার রায়ের প্রসঙ্গ টেনেছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ। প্রশ্ন তুলেছেন নতুন রায়ের ‘গ্রাউন্ড’ বা ‘ভিত্তি’ নিয়ে। অভিজিৎ বলেন, ‘‘২৬ হাজার চাকরি যাদের বাতিল হল, তারাও তো অনেক বছর চাকরি করেছিল। তা হলে কি সেই রায় ভুল? আমার মনে হয় এটা কোনও গ্রাউন্ড হতে পারে না।’’ হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘‘ডিভিশন বেঞ্চের বিচার করার ক্ষমতা আছে, তারা যা ভাল মনে করেছে, করেছে। আমার কিছু বলার নেই। বিচারপতি হিসাবে আমি যা মনে করেছিলাম, বলেছিলাম।’’ তাঁর নির্দেশ খারিজ নিয়ে সে ভাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তমলুকের বিজেপি সাংসদ।

কী বললেন মমতা
৩২ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ খারিজের রায়ে খুশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মালদহ থেকে তিনি বলেছেন, ‘‘কথায় কথায় কোর্টে গিয়ে চাকরি খেয়ে নেওয়া, এটা তো ঠিক নয়। চাকরি তো দেওয়া দরকার, খেয়ে নেওয়া নয়। বিচার বিচারের মতো চলবে। বিচারকে আমরা শ্রদ্ধা করি। আমি সবচেয়ে খুশি যে, আমার চাকরিরত ভাইবোনেদের চাকরি থাকল।’’
কী বললেন শিক্ষামন্ত্রী
চাকরি বহালের রায়ের পর মুখ খুলেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘‘মহামান্য হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে অভিনন্দন জানাই। হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায় বাতিল হয়েছে। ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রইল। শিক্ষকদেরও সতত শুভেচ্ছা। সত্যের জয় হল।’’
জেলায় জেলায় আবিরখেলা
চাকরি বহাল থাকছে, খবর পেয়েই জেলায় জেলায় উল্লাসে মেতেছেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ৩২ হাজার শিক্ষকের পরিবার। দিকে দিকে আবিরখেলা শুরু হয় রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই। মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে কোথাও কোথাও। আগের রায় নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন শিক্ষকেরা। বলেছেন, সেই রায় ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ছিল। কেউ আবার আবেগতাড়িত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। হাই কোর্ট চত্বরেও শিক্ষকদের একাংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

