‘বালুদা’র মাসোহারা! রঙিন ডায়েরির পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে কালো টাকার রহস্য, উৎস জানতে ময়দানে ইডি

মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে পাঠানো ‘মাসোহারা’র হিসেব কি এবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তদন্তকারীদের হাতে? রেশন বণ্টন দুর্নীতির তদন্তে নেমে উদ্ধার করা এক ডায়েরিতে ব্যবসায়ীদের পাঠানো মাসিক টাকার হিসেব মিলেছে বলে ইডির একটি সূত্রের দাবি। ডায়েরিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা। তাতেই একজনের বয়ানে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীর কাছে মাসে মাসে টাকা পৌঁছে দেওয়ার এই তথ্য উঠে এসেছে বলে আধিকারিকদের একটি অংশের দাবি। দাবি আরও যে, প্রয়োজনে তাঁরা বিষয়টি আদালতেও জানাতে পারেন।

খাদ্য দফতরের বিভিন্ন কাজ আদায়ের জন্য রেশন ব্যবসায়ীরা ওই টাকা তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়কে (বালু) দিতেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। প্রত্যাশিত ভাবেই এ সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে ডায়েরিতে থাকা হিসেব নিয়ে মন্ত্রীকে ইডি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

দিন কয়েক আগে রেশন বণ্টন দুর্নীতির তদন্তে কলকাতা, হাওড়া, সল্টলেক-সহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই সময়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে নোটবুকের পাশাপাশি একটি ডায়েরিও বাজেয়াপ্ত করে ইডি। সেই ডায়েরির কয়েকটি পাতা ওল্টানোর পরেই আধিকারিকদের নজরে আসে পাতা জুড়ে লেখা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম এবং তার পাশাপাশি টাকার অঙ্ক।

আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ব্যবসায়িক হিসাব-কেতাব মনে হলেও আসলে তা মন্ত্রীকে পাঠানো টাকার হিসাব বলেই জানতে পেরেছেন আধিকারিকেরা। মন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত ব্যবসায়ীরা নিয়মিত নগদে টাকা পাঠাতেন বলে ইডি সূত্রে খবর। সেই টাকা কখনও কখনও খোদ খাদ্যভবনেও পৌঁছে দেওয়া হত। টাকা হস্তান্তরের পর তার অঙ্ক ওই ডায়েরিতে নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে ইডির কাছে দাবি করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত ওই ডায়েরিতে বেশ কয়েক বছরের পুরনো হিসাব লেখা রয়েছে। যদিও সময়কাল যা-ই হোক, রেশন দুর্নীতির তদন্তের ক্ষেত্রে এর মূল্য কম নয় বলেই অভিমত এক তদন্তকারীর। ডায়েরিতে নাম-থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে ইতিমধ্যে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে ইডি। যার মধ্যে বেশ কয়েক জনকে জেরা করা হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।

বাজেয়াপ্ত ওই ডায়েরির বেশ কিছু পাতা জুড়ে রয়েছে একাধিক ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীর নাম। নামের পাশে টাকার অঙ্কও আছে। ডায়েরিতে উল্লেখ থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি দফায় দফায় টাকা দিয়েছেন। সেইমতো একই ব্যক্তির নাম একাধিক বার তারিখ এবং টাকার অঙ্ক-সহ নথিভুক্ত করা হয়েছে। যা দেখে তদন্তকারীরা মনে করছেন, বাকিবুর রহমানের মতো ব্যবসায়ীরা বেআইনি ভাবে দরপত্র টেন্ডার পেতে এবং গোটা বছর যাতে বিভিন্ন ‘সুযোগসুবিধা’ নিতে পারেন, তার জন্য প্রতি মাসে এই টাকা ‘মাসোহারা’ হিসেবে পাঠাতেন। রেশন দুর্নীতির অভিযোগে অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হয়েছেন মিল মালিক এবং ব্যবসায়ী বাকিবুর।

ডায়েরির সব পাতা খতিয়ে দেখে তদন্তকারীরা দেখেছেন, কোনও মাসে কয়েক হাজার, তো কখনও লাখ টাকা ‘মাসোহারা’ দেওয়ার হিসাব ডায়েরিতে লেখা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সেই অঙ্ক কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। ইডির দাবি, ব্যবসায়ীদের থেকে প্রাপ্ত নগদ টাকার অঙ্ক যেমন লেখা রয়েছে, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে সেই টাকা কাকে বা কোথায় পাঠানো হয়েছে, সেই হিসাবও রয়েছে। ডায়েরিতে পাওয়া টাকা আসা-যাওয়ার যে হিসাব রয়েছে, তা-ও মিলিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।

ইডি সূত্রের দাবি, ১০ জনেরও বেশি ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই ডায়েরিতে। যার সিংহভাগই রেশন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে জানতে পেরেছেন তাঁরা। ডায়েরিতে নাম-থাকা ব্যক্তিদের খাদ্য দফতরে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলেও এক জনের বয়ানে উঠে এসেছে। খাদ্য দফতরে বিভিন্ন কাজে ‘ঘুরপথে’ সাহায্য পেতেই নিয়মিত ওই টাকা দেওয়া হত বলে কয়েদজনের বয়ানে দাবি করা হয়েছে। কখনও নিজে বা কখনও সহযোগীদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠানো হত। এর মধ্যে অনেকের নাম রেশন দুর্নীতির ‘সিন্ডিকেটে’ যুক্ত বলেও ইডির তদন্তে উঠে এসেছে। ওই বিষয়ে বালুর প্রাক্তন আপ্তসহায়ককে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ‘মাসোহারা’ দেওয়া সিন্ডিকেটের ওই সদস্যেরা যে দুর্নীতিতে জড়িত, সে বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত তদন্তকারীরা। একাধিক বয়ানে সেই তথ্য উঠে এসেছে। সেই টাকা যেমন নগদে দেওয়া হয়েছে, তেমনই মন্ত্রীর আদেশ মতো ঘুরপথে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হত বলেও জানতে পারছেন তদন্তকারীরা। ডায়েরিতে মন্ত্রীর জন্য পাঠানো সেই নগদ টাকার হিসেবই নথিভুক্ত করা থাকত।

ইডির দাবি, উপরে ‘বালুদা’ লেখা মেরুন ডায়েরিতে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়কেই নির্দেশ করা হয়েছে। ডায়েরিতে-থাকা কোটি কোটি টাকার যে হিসাব রয়েছে, তা রেশন দুর্নীতির মাধ্যমে এসেছে কি না, তা যেমন খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তেমনই দুর্নীতির ‘ছাড়পত্র’ পেতে নিয়মিত মন্ত্রীকে টাকা দেওয়া হয়েছিল কি না, তা-ও খুঁজেপেতে দেখছে ইডি।

সাধারণ মানুষের প্রাপ্য রেশনের গম খোলাবাজারে বিক্রি করে নিজের সম্পত্তি বাড়িয়েছেন বাকিবুর। ‘অতি প্রভাবশালী’ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় রেশন দুর্নীতিতে আর্থিক ভাবে ‘লাভবান’ হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ইডির দাবি। বালুকে গ্রেফতারের পর রেশন দুর্নীতির ‘মানি ট্রেল’ খুঁজতে শনিবার কলকাতা, নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। তদন্তে উঠে এসেছে আরও কয়েক জন মিল মালিকের নাম। পাশাপাশি, ডায়েরিতে নাম-থাকা ব্যক্তিরাও রয়েছেন ইডির আতশকাচের তলায়। কেন তাঁরা নগদ টাকা বালুকে পাঠালেন এবং সেই টাকার উৎস কী, তা জানতে চাওয়া হবে তাঁদের কাছে।

যদিও ওই ডায়েরিতে লেনদেনের যে হিসাব রয়েছে, তাতে কোনও স্বাক্ষর নেই বলেই ইডি সূত্রে খবর। সে ক্ষেত্রে ডায়েরিতে লেখা হিসাব মেলাতে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ও প্রয়োজন বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। সেই কারণে ডায়েরিতে উল্লিখিত টাকা কোথা থেকে এসেছে বা কার কাছে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। পরবর্তী কালে ‘বালুদা’ লেখা ডায়েরি তাঁদের তদন্তে ‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.