বাংলা সিনেমার দর্শক হিসেবে আজ হয়তো বড় খুশির দিন। কেন? কারণ আজ শহরে, এই ঘনঘোর বর্ষায়, মুক্তি পাচ্ছে অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবিটি। যে ছবির বক্স-অফিস ভাগ্য হয়তো সম্পূর্ণভাবেই অনিশ্চিত। কিন্তু ছবি হিসেবে, মানে ‘সিনেমা’ হিসেবে বাংলা ভাষায় এমন ছবি (দুই বাংলা মিলিয়েই বলছি) বিশেষ তৈরি হয় না। সিনেমার একটা অন্য রকম ভাষা আছে, যা রসিক দর্শকমাত্রেই বোঝেন। এবং সে ভাষায়, আধুনিক সময়ে, সংলাপের তেমন গুরুত্ব নেই। যার মানে সংলাপ ছাড়া ছবি, তা-ও ঠিক নয়। কিন্তু এমন ছবি, যা সংলাপের ভারে ন্যুব্জ নয়। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই সংলাপের জায়গা আধুনিক ‘সিনেমা’য়। বাকিটা ছবির ভাষা। দৃশ্যকল্প, ক্যামেরার কাজ, আবহ, আলো, সম্পাদনার মারপ্যাঁচ, এইসব আর কি। এমন ছবি যে বাংলায় তৈরি হয় না, তা অবশ্যই নয়। ২০২১ সালে ঈশান ঘোষ পরিচালিত ‘ঝিল্লি’ মুক্তি পেয়েছিল। তার পর ২০২৩-এ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী পরিচালিত ‘মায়ার জঞ্জাল’। এ সবের অনেক আগে, ২০১৪-য় আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘আসা যাওয়ার মাঝে’। লক্ষ্যণীয়, এর প্রত্যেকটিই স্বাধীন বা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবি ছিল মোটামুটি। কারণ বক্স অফিস মুখাপেক্ষী ভারতীয় প্রযোজনা ব্যবসার আঙিনায় এমন ছবি করার বা করতে সাহস দেখানোর মতো বুকের পাটা কোনও পেশাদার প্রযোজকেরই নেই। কারণ যে ছবিতে সংলাপের অভাব, তা ভারতীয় দর্শক দেখতে বা গ্রহণ করতে তেমন অভ্যস্ত নন। যে কারণে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত জগদ্বিখ্যাত হয়েও খোদ ভারতে কখনওই জনপ্রিয় হতে পারেনি সে ভাবে। এ দেশে আজও রবিশঙ্কর বা ভীমসেন যোশীর চেয়ে কিশোরকুমার বা মহম্মদ রফি জনপ্রিয়তায় এগিয়ে। কারণ, কিশোর-রফির গানে শব্দ আছে। তাই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ কখনওই স্বাভাবিক ভাবে দর্শকের আশীর্বাদধন্য হবে না। যদি হয়, তা হবে আশাতীত পাওনা।
অভিনন্দন এই ছবিতে এক ভীতু, কুঁকড়়ে থাকা, একাকী, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির গল্প বলেছেন। গড় বাঙালি। যে মাছের বাজারে রুই-কাতলা দূর থেকে দেখে, বড়ি ফেরে পুঁটি বা মৌরলা মাছ কিনে। যে জীর্ণ ভাড়াবাড়িতে দিন গুজরান করে, যে ট্রামের জানালার কাছে বসে রাস্তার বিজ্ঞাপনে দেখানো স্বপ্নটাকে প্রতিদিন কেবল দেখেই যায়— কারণ তার হাত অতটাই লম্বা; যার অস্বস্তি হওয়া সত্বেও শহরের বিটকেল শব্দবিচ্ছুরণ, যাকে ইংরেজিতে ‘ক্যাকোফোনি’ বলে, তার থেকে মুক্তি চেয়েও পায় না। যে অতি অল্পেই সন্তুষ্ট হতে শিখে গিয়েছে, বাধ্য হয়ে। মানিকবাবু (চন্দন সেন) সামান্য রোজগার বাড়ানোর জন্য কেরানি পেশার পর সন্ধ্যায় আবৃত্তির মতো নিতান্ত ‘তুচ্ছ’ বিষয়ের একটি টিউশনি করে, যা আখেরে স্থায়ী হয় না। ইংরেজিকে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই লোকটারই একটা আমরণ জেদ থাকে; তার হাতে পোঁতা, ঢলঢল কচি পাতা-ফুলের গুল্মগুলিকে আকাশের তলায় জায়গা করে দেওয়ার। বাবা (নিমাই ঘোষ) মারা যাওয়ার পর, যখন বাড়িওয়ালা (অরুণ গুহঠাকুরতা) জানায়, আর এক মাসের মধ্যে তাকে বাড়ি খালি করতে হবে, তখন নতুন বাড়ির খোঁজে তার একমাত্র দাবি থাকে, “কিন্তু একটা ছাদ তো চাই; আমার গাছগুলো…”।
এই শহরের এই বাসিন্দারা আসলে এক ছায়াজগতের মানুষ, যাদের সূর্যকিরণ সহ্য হয় না। মানিকবাবুরও হয় না। আর এই সূত্রেই তাকে আড়াল করে একপুঞ্জ মেঘ।
সেই ধীরে-ধীরে একদিন হয়ে ওঠে মানিকবাবুর বন্ধু, ‘মানিকবাবুর মেঘ’। প্রথমে স্বভাব-ভীতু মানিকবাবু তাকে ভয় পায়, কিন্তু নাছোড়বান্দা সেই মেঘ যে আসলে তার শুভাকাঙ্ক্ষী, তা বুঝে একদিন নিঃসঙ্গ মানিক সেই মেঘপুঞ্জকে প্রেমিকারূপে ভালোবাসতে, কথা বলতে শুরু করে। মানিকের তাপদগ্ধ জীবনে তার পর থেকে নেমে আসে স্নিগ্ধ ছায়া, সমাধান হয় যায় সব অশান্তির। শান্ত হয়ে আসে, বিলুপ্ত হয় ‘ক্যাকোফোনি’, জায়গা করে নেয় ‘সিম্ফোনি’। অভিনন্দন এই কাহিনির পরতে-পরতে বড় মায়া বুনে দিয়েছেন। ছবির এক-একটা ফ্রেম দেখলে চমকে উঠতে হয়। একেবারে প্রথম দিকের এক দৃশ্যে মানিকের গুল্ম সাজানো জীর্ণ ছাদের একটি দৃশ্য আছে। সেখানে পর্দা-ভাঙা সাদা-কালো মান্ধাতার আমলের টেলিভিশন সেট চোখে পড়ে। তার ভিতর গুল্মের ভিড়। সেই চৌকোনা বাক্সের পিছনে মানিক বসে গুল্মে জল দিচ্ছে। ক্যামেরা তার বিপরীতে বসানো। ধরা পড়ছে সেই ভাঙা ফ্রেমের মধ্যে মানিক, গুল্ম, জল-দেওয়া। গায়ে কাঁটা দেয় এমনতর দৃশ্যে। অথবা শেষের দিকে, বন্ধুত্ব হওয়ার পর ময়দানের টপ-শটে যখন মেঘের দৃষ্টিকোণ থেকে কোট-প্যান্ট পরিহিত মানিককে শুয়ে থাকতে দেখা যায় ঘাসের উপর। বারে-বারে মনে আসে সে দৃশ্য। মনে হয়, এমন স্নিগ্ধ শান্তির জায়গা এ শহরেও আছে?
আর মনে থাকে চন্দনের হাসি, মেঘের আগমনে। সে বড় পরিপূর্ণতার, বড় স্বস্তির। মনে থেকে যায় নিমাই ঘোষের নিস্তব্ধ কথা বলা, অবোলা চোখে বিছানাবন্দি এক বৃদ্ধের জানলা দিয়ে আসা এক টুকরো আলোর পানে অবিরাম চেয়ে থাকা; অথবা অরুণবাবুর মায়াভরা “কিছু পেলে, বাবা?” সংলাপ।
হৃদয়ে আলোড়ন তোলে মেঘপুঞ্জের উত্তর দেওয়ার ধরন, সারা আকাশ কালো মেঘগর্জনে ভাসিয়ে অবিরাম ধারাপাত, অথবা একটি রাস্তার আলোর জ্বলা-নেভায় কথোপকথন। এক মায়াজগতের সৃষ্টি হয়ে চোখের সামনে, যা দর্শককে বাধ্য করে নীরবে অবলোকন করে যেতে। বাধ্য করে এটাই যে আধুনিক ‘সিনেমা’র ভাষা, সেই সারসত্যটি উপলব্ধি করতে। প্রথম ছবিটিকেই অভিনন্দন যে সফল ভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন, তার জন্য এই নবীন পরিচালকের প্রতি হৃদয়মথিত অভিনন্দন রইল।