মহাবিশ্বের ধারক সর্বব্যাপী নারায়ণ রাবণের মতো অসুর শক্তিকে নির্মূল করার জন্য ইশ্বাকু বংশের রাজা দশরথের পুত্রের মাধ্যম রূপে হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন..!
রাজা দশরথ এই সময়ে পুত্রকামেষ্ঠী যজ্ঞ করেন। একজন উজ্জ্বল প্রজাপত্য ব্যক্তি, ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে, রাজার তিন রাণীর জন্য রাজাকে পায়েস (ক্ষীর) দেন। তিনজন সাধ্বী রাণীই এই প্রসাদ প্রাশন হিসেবে গ্রহণ করেন। কালক্রমে তিন রাণীর চার পুত্র হয়।
মাতা কৌশল্যার শ্রীরাম রূপে এক উজ্জ্বল পুত্র, রানী সুমিত্রার লক্ষ্মণ এবং শত্রুঘ্ন যমজ পুত্র আর কৈকেয়ী ভরতের জন্ম দেন।
রাজা দশরথ পরম খুশি। কোশল জনপদে অপার আনন্দের সীমা নেই কারণ তারা পেয়েছে চার রাজকুমারের আবির্ভাবের খবর। অযোধ্যায় সবচেয়ে বড় উৎসব আরম্ভ হয়েছে। অযোধ্যা সহ সমগ্র কোশল জনপদের নাগরিকেরা মহা ধুমধামে রাজকুমারদের জন্মোৎসব উদযাপন করছে।
সময়ের চক্র সোজা ও মসৃণভাবে চলছে।
চার রাজপুত্র বড় হওয়ার সঙ্গে অভিজ্ঞ আচার্যগণ তাদের সব ধরনের শিক্ষা দেওয়া দিতেছে। সব ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ চলছে। এই চার রাজপুত্র জনগণের জন্য কাজ পরিচালনা, শহর নির্মাণ, কোষাগার পরিচালনা, কর আদায়, ন্যায়বিচার প্রদানের মতো সমস্ত বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। এসবের মধ্যে রামের স্বতন্ত্র পরিচয় দৃশ্যমান। বাকি তিন ভাই পরম শ্রদ্ধায় শ্রীরামকে সম্মান জানাচ্ছেন। তার প্রতিটি কথার গুরুত্ব মেনে নেয়।
শ্রীরাম সকল বিষয়ে অগ্রগণ্য। ভাইদের জন্য চিন্তিত, অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতি, সংযত আচরণ, গুরুজন, শিক্ষক ও ঋষিদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, এইগুলিই শ্রীরামের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ। কিন্তু এই তিন ভাইয়ের মধ্যে শত্রুঘ্নের যমজ লক্ষ্মণের প্রতি শ্রীরামের বিশেষ স্নেহ। আবার শ্রীরাম লক্ষণের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। শ্রীরামও লক্ষ্মণ ছাড়া অন্ন গ্রহণ করেন না।
লক্ষ্মণো লক্ষ্মী সম্পন্নো বহিঃ প্রাণ ইব অপরাঃ।
ন চ তেন বিনা নিদ্রাম্ লভতে পুরুষোত্তমঃ ॥৩০॥
(বালকান্ড/অষ্টাদশ সর্গ)
সময়ের চক্র এখনো ঘুরছে।
ইতিহাসের পাতা ক্রমাগত এগিয়ে চলে।
এই চার রাজপুত্র এখন বয়ঃসন্ধিতে যৌবনের দোড়গড়ায় প্রবেশ করছেন। সকলেই অস্ত্র-শাস্ত্রে পারদর্শী হয়েছেন। বিশেষ করে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের তীরন্দাজ এবং অস্ত্রশস্ত্রের দক্ষতা সমগ্র কোশল জনপদে আলোচনার বিষয়। অযোধ্যার নাগরিকরা শ্রীরামের ন্যায়বিচারের প্রশংসা করছেন।
এমন সময় একদিন রাজা দশরথের সকালের বৈঠকে খবর আসে যে কুশিক বংশ জাত বিশ্বামিত্র এসেছেন অবধের রাজা দশরথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। রাজা দশরথ একটু অস্থির। ঋষি বিশ্বামিত্রের আগমন সংবাদে তিনি আনন্দিত কিন্তু তাঁর অস্বস্তির কিছু কারণ লক্ষ্য করা যায় যে বিশ্বামিত্র একজন তপস্বী, যিনি কঠোর ব্রতচারী এবং খুব তেজস্বী তপঃপূঞ্জিত ঋষি।
তাঁকে দেখে রাজা দশরথ খুশি হন এবং তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ঘ্য প্রদান করেন। দুজনেই একে অপরের খোঁজখবর নেন। পরে অবধের রাজা দশরথ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করেন, “মুনিবর, আপনার দর্শনে আমার বাড়ি আজ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে আপনার দর্শনের কারণেই আমি পবিত্র স্থানে ভ্রমণের সৌভাগ্য পেয়েছি। আমাকে বলুন! আপনার শুভ আগমনের উদ্দেশ্য কি?”
রাজা দশরথের এই কথা শুনে ঋষি খুশি হন। তিনি বলেন, “হে আওধ রাজ, এই বাচন শুধু আপনার মতো প্রচন্ড-প্রভাবী রাজারই শোভনীয়। এখন আমি তোমাকে আমার আগমনের উদ্দেশ্য বলি।”
“হে মহাপুরুষ, আমি কিছু সুনির্দিষ্ট জ্ঞান এবং সিদ্ধি অর্জনের জন্য একটি অনুষ্ঠান করছি। কিন্তু কিছু অসুর শক্তি এই আচারে হস্তক্ষেপ করছে। বিশেষ করে মারিচ এবং সুবাহু দুই রাক্ষস আমার অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছে। “তারা উভয়েই শক্তিশালী এবং শিক্ষিত। কিন্তু তারা আমার আচার সম্পন্ন করতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
ব্রত মে বহুশঃ চীর্ণ সমাপ্ত্যাম্ রাক্ষসবিমৌ।
মারিচঃ च সুবাহুঃ च বীর্যবন্তৌ সুশিক্ষিতৌ॥৫॥
(বালকান্ড/উনবিংশতি সর্গ)
“হে মহারাজ, এই রাক্ষসরা আমার যজ্ঞবেদীতে রক্ত-মাংস ক্ষেপণ করেছে। এই কারণে আমার সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে যাচ্ছে। তাই, আমি হতাশা গ্রস্থ হয়ে আপনার কাছে এসেছি। মহারাজ, এই দুই রাক্ষস সন্ত্রাসবাদের পুরোধা রাবণের অনুগত দাস। আজ সমগ্র আর্যাবর্তে এই রাক্ষসদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।”
“হে নৃপশ্রেষ্ঠ, আমি আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীরামকে আমার আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিয়ে যেতে অনুরোধ করি। হে ভূপতি, আমি বিশ্বাস করি যে আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনন্দন ছাড়া অন্য কেউ এই রাক্ষসদের হত্যা করার সাহস ধরে না।”
মহান ঋষি বিশ্বামিত্রের কথা শুনে রাজা দশরথ কেঁপে ওঠেন। ‘রাবণের এমন দুষ্ট ও বিশ্বাসঘাতক রাক্ষসদের কাছে আমি কীভাবে আমার যুবক ছেলেকে পাঠাব?’ রাজা দশরথ অজ্ঞান হয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফেরার পর পরম বিনয়ের সঙ্গে তিনি বলেন, “হে মহর্ষি, আমার মনিশ্রেষ্ঠ রাম এখনও ষোল বছর বয়স হয়নি। আমি তাকে এই অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠাব কি করে?”
ঊনষোদশবর্ষো মে রামো রাজীবলোচনঃ।
ন যুদ্ধোযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈ ॥২॥
(বালকান্ড/বিংশতি সর্গ)
রাজা দশরথ শ্রেষ্ঠ ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে প্রার্থনা করেন যে, তাঁর অক্ষৌহিণী সেনা আছে। অত্যন্ত দক্ষ, সুরবীর সাহসী সৈনিক, দানবদের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে। “আপনি ওদের নিয়ে যান প্রভু। প্রয়োজনে আমি নিজে আপনার যজ্ঞ রক্ষা করতে আসতে পারি। কিন্তু রামকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।”
রাজা দশরথের এই কথা শুনে বিশ্বামিত্র আবার বললেন, “মহারাজ, এই সন্ত্রাসী রাক্ষস রাজা ‘রাবণ’য়ের, যিনি পুলস্ত্য বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাতের বেলা সমগ্র আর্যাবর্তের বাসিন্দাদের প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছেন। পরাক্রমশালী অশুভ আত্মা, তিনি নিজে যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটানো একটি তুচ্ছ কাজ বলে মনে করেন। তাই তিনি মারিচ ও সুবাহুর মতো তার সন্ত্রাসীকে পাঠিয়েছেন।”
পৌলস্ত্যবংশপ্রভব রাবণো নাম রাক্ষসঃ।
সা ব্রাহ্মণ দত্তবরস্ত্রেলোক্যম্ বাধতে বৃষম্ ॥১৬॥
(বালকান্ড/বিংশতি সর্গ))
মহান ঋষি বিশ্বামিত্রের এই কথা শুনে রাজা দশরথ দুঃখে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “হয়তো আমিও রাবণের এমন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারলে, আমার ছেলে দাঁড়াবে কী করে?”
একথা শুনে বিশ্বামিত্র ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজাকে ব্যাখ্যা করেন যে “অযোধ্যার বাইরে এই অসুর শক্তির আতঙ্ক রয়েছে। ঋষি-ঋষিরাও যদি তাদের যজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে না পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে তা আমরা বুঝতে পারি। এই সন্ত্রাস থেকে বিশ্বামিত্রের মতো একজন মহান ঋষিকে বাঁচাতে হবে। তাই শ্রীরামের যাওয়াই উপযুক্ত হবে। শ্রীরাম সমস্ত বিদ্যার শক্তিশালী কলাগুলিতে পারদর্শী। তাই শ্রীরামকে পাঠানোই ভালো হবে।”
ঋষি বশিষ্ঠের কথা শুনে রাজা দশরথ শ্রীরামকে পাঠাতে প্রস্তুত হলে লক্ষ্মণ সাথে যেতে আগ্রহ দেখায়। তাই নিশ্চিত হয় যে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্র মুনির সাথে যাবেন। রাজা দশরথ প্রসন্ন চিত্তে বিদায় নিয়ে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ঋষিদের যজ্ঞস্থলে রওয়ানা করেন লক্ষ্মণ ও শ্রীরাম।।
- প্রশান্ত পোল
(ক্রমশঃ)