‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে’ বেরিয়ে এসেছিল তল্লাশি অভিযানে। প্রতারণায় অভিযুক্তের বাড়িতে গিয়ে খাটের তলায় সুড়ঙ্গের হদিস পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন পুলিশ আধিকারিকেরা! গত সোমবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির সেই ঘটনায় অবশেষে তদন্তকারীদের জালে ধরা পড়লেন সেই ‘প্রতারক’ সাদ্দাম সর্দার। বারুইপুর আদালতের নির্দেশে আগামী ১২ দিন তিনি পুলিশি হেফাজতেই থাকবেন। তাঁর বাড়ির যে সুড়ঙ্গ নিয়ে এত হইচই গত দু’দিন ধরে, সেই সুড়ঙ্গ নিয়ে কিন্তু রহস্যের জট এখনও কাটল না। তবে তদন্তকারীদের অনুমান, সাদ্দামকে জেরা করে এ বার সব প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে।
বুধবার রাতে কুলতলির ঝুপড়িঝাড়ার বানীরধল এলাকার একটি মাছের ভেড়ির আলাঘর থেকে গ্রেফতার করা হয় সাদ্দামকে। তাঁর সঙ্গে গ্রেফতার হন কুলতলির সিপিএম নেতা মান্নান খানও। পুলিশ সূত্রে খবর, সাদ্দাম যে মাছের ভেড়ির আলাঘরে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, সেটি তাঁরই। শুধু তা-ই নয়, সাদ্দামের বিরুদ্ধে যে প্রতারণাচক্র চালানোর অভিযোগ উঠেছে, তাতে মান্নানও জড়িত বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। বৃহস্পতিবার সাদ্দাম ও মান্নান— দু’জনকেই বারুইপুর মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। আদালতে সাদ্দামকে সমাজসেবী বলে দাবি করে জামিনের আবেদন করেছিলেন তাঁর আইনজীবী। পাশাপাশি, তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসদমন আইনের যে ধারা দেওয়া হয়েছে, তা-ও ঠিক নয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আদালত তাতে কান না দিয়ে সাদ্দামের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেয়। মান্নানেরও পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। তার আগে বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার পলাশচন্দ্র ঢালি জানান, গত সোমবারের ঘটনায় সাদ্দাম ও মান্নান ছাড়াও আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন হলেন সাদ্দামের স্ত্রী রাবেয়া এবং সাদ্দামের ভাই সায়রুলের স্ত্রী মাসুদা। এখন সায়রুল-সহ আরও বেশ কয়েক জনের খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাবেয়া ও মাসুদার জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
গত সোমবার কুলতলির জালাবেড়িয়া-২ পঞ্চায়েতের পয়তারহাটে সাদ্দামের বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে যায় পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো সোনার মূর্তি দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, সকাল ৭টায় সাদা পোশাকে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে সাদ্দামকে ধরে ফেলেছিল। এর পরেই সাদ্দামের বাড়ির পাশাপাশি পড়শি মহিলারা পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। অভিযোগ, তখন পুলিশ অফিসারদের মারধরও করা হয়। সাদ্দামের ভাই সায়রুল পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালান বলেও অভিযোগ। পুলিশের দাবি ছিল, গুলি কারও গায়ে না লাগলেও স্থানীয়দের মারধরে তিন জন পুলিশ অফিসার জখম হয়েছিলেন। সেই সুযোগেই পালিয়ে যান সাদ্দাম ও সাইরুল। এর পরেই এলাকায় বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তল্লাশি চলে সাদ্দামের বাড়িতে। সেই সময় বাড়ির ভিতরে মেলে সুড়ঙ্গ। বাইরে থেকে গ্রিলের দরজা দেওয়া। দরজা খুলে ওই কংক্রিটের সুড়ঙ্গে নেমে পুলিশ দেখে, হাঁটুজল জমে আছে। সুড়ঙ্গটি শেষ হয়েছে পাশের খালে। সেই খাল আবার গিয়ে পড়েছে পাশের মাতলা নদীতে।
তদন্তকারীদের অনুমান, সাদ্দাম দীর্ঘ দিন ধরেই প্রতারণাচক্র চালান। সেই চক্রে আরও অনেকে জড়িত। সাদ্দামের রাজনৈতিক যোগ এখনও সেই ভাবে প্রকাশ্যে না এলেও স্থানীয়ের একাংশের দাবি, স্থানীয় তৃণমূল ও সিপিএমের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল। ধৃত মান্নান গত পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন। তাঁর যোগাযোগ অনেক দিনের। পুলিশের একটি অংশের সঙ্গেও সাদ্দামের ‘ঘনিষ্ঠতা’ ছিল। অনেক খবরাখবর সেখান থেকেই পেতেন সাদ্দাম। আগেও এক বার একটি খুনের মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাদ্দামের বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি অভিযানে যাচ্ছে কি না, সেই খবরও তিনি জানতে পারতেন সেই ‘ঘনিষ্ঠ’ পুলিশকর্মীদের কাছ থেকে। তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, বাড়ির সামনে পুলিশ চলে এলে যাতে দ্রুত খালে পৌঁছে, পরে নদীপথ ধরে পালানো যায়, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন সাদ্দাম।
কিন্তু শুধু পালানোর জন্যই এত কসরত করে কংক্রিটের সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল? এই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। বছর সাতেক আগে উত্তরবঙ্গের চোপড়ায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এমনই এক সুড়ঙ্গের খোঁজ পেয়েছিল পুলিশ। মনে করা হয়েছিল, সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে চোরাচালান হয়। পুলিশ মহলের একাংশের প্রশ্ন, সাদ্দামের সুড়ঙ্গ দিয়েও কি তা-ই হত? তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ, শুধু মূর্তি দেখিয়েই প্রতারণা নয়, সাদ্দাম সম্ভবত বড় কোনও বেআইনি কারবারের সঙ্গে যুক্ত। আর সেই কারবার চলত এই পাকাপোক্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে। যদিও সুড়ঙ্গটি পরীক্ষা করে দেখে তদন্তকারীরা বুঝতে পেরেছেন, সেটি অনেক দিন ধরেই ব্যবহার করা হয়। গ্রিলের দরজায় জং ধরে গিয়েছে। সুড়ঙ্গের ভিতরে যে ভাবে জল জমে রয়েছে, তাতে যাতায়াত করা খুব একটা সহজ নয়। ফলে সুড়ঙ্গের ব্যবহার যে প্রায়শই হত, তা-ও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সাদ্দাম এখন তাঁদের হেফাজতে। তাঁকে জেরা করেই সুড়ঙ্গ-রহস্যের শীঘ্র সমাধান হবে।
আদালতে কী হল?
বারুইপুর আদালতে সাদ্দাম ও মান্নানের ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন করেছিলেন সরকারি আইনজীবী। আদালতে তিনি জানান, দু’জনের নামেই জয়নগর ও কুলতলি থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে এখনও কোনও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা না গেলেও পুলিশের দিকে যে বন্দুক দেখানো হয়েছিল গত সোমবারের ঘটনার সময়, তার ভিডিয়ো ফুটেজ রয়েছে বলে আদালতে দাবি করেন সরকারি আইনজীবী। পাল্টা সাদ্দামের আইনজীবী দাবি করেন, বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। সাদ্দামের কাছে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সাদ্দামের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল। সাদ্দামকে কেন পুলিশ ধরতে গিয়েছে, গ্রামবাসীরা তা-ই জানতে চেয়েছিলেন পুলিশের কাছে। সাদ্দামের আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘‘সাদ্দাম একজন সমাজসেবী। সাদ্দামের সঙ্গে থানারও যোগাযোগ রয়েছে। বার বার থানায় যেতেন সাদ্দাম। রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতেন। তা হলে কী করে ‘টেররিস্ট’ হলেন? ১১৩ ‘টেরটিস্ট অ্যাক্ট’ যে দেওয়া হয়েছে, তা একেবারে যুক্তিহীন। সেই রকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি।’’ মান্নানের আইনজীবীও জামিনের আবেদন করে আদালতে জানান, তাঁর মক্কেলের নাম কোথাও নেই। পুলিশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগও তাঁর নামে ছিল না। মান্নানের আইনজীবী বলেন, ‘‘ভেড়ি থাকতে দেওয়ার জায়গা নয়। আমার মক্কেলের ফিশারির আশপাশে কেউ যদি থাকেন, তাতে আমার মক্কেলের কী করার আছে? আমার মক্কেলকে কেন গ্রেফতার করা হল? মান্নান ‘টেররিস্ট’ নন। কোনও ভাবেই যুক্ত নন এই কেসে।’’ দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব শেষে দু’জনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। বৃহস্পতিবার রাবেয়া ও মাসুদার জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। তাঁদের দু’জনেরই সন্তান রয়েছে বলে আদালতে সওয়াল করেছিলেন আইনজীবী। কিন্তু তাঁদেরও জামিন মঞ্জুর করেনি আদালত। জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সুপার কী বললেন
বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, গত ১ জুলাই জয়নগর থানায় ১২ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। সেই মামলার তদন্তে নেমে সাদ্দামের নাম উঠে আসে। গত সোমবার পয়তারহাট গ্রামে তাঁকে ধরতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে পালান সাদ্দাম ও তাঁর ভাই সাইরুল। তার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের খোঁজ চলছিল। এসপি জানান, তদন্তে জানা গিয়েছে, প্রতারণাচক্রে জড়িত রয়েছেন ১২ থেকে ১৪ জন। বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে। প্রসঙ্গত, কুলতলির ঘটনা নিয়ে আগেই মুখ খুলেছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। সুড়ঙ্গ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টিকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। আবার উত্তেজনা ছড়ানোরও দরকার নেই। পুলিশ তদন্ত করছে।’’
সাদ্দামের সঙ্গে রাজনীতির যোগ?
সাদ্দামদের চক্রের সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি যোগ পাওয়া যায়নি বলেই দাবি তদন্তকারীদের। তবে এর মধ্যেই তৃণমূলের জালাবেড়িয়া-২ অঞ্চল সভাপতির সঙ্গে সাদ্দামের ঘনিষ্ঠতার কথা প্রকাশ্যে আসে। অঞ্চল সভাপতি ইয়ামিন মিস্ত্রি অবশ্য তা মানেননি। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, সাদ্দামদের পাশাপাশি বোটো, সাকাত নামে দু’জনের নাম চক্রের মাথা হিসেবে উঠে এসেছে তদন্তে। এই বোটো, সাকাতের সঙ্গেও তৃণমূলের যোগাযোগ ছিল। তারা তৃণমূলের বুথ সদস্য ছিলেন বলে দাবি। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ওই চক্রের সঙ্গে দলের যোগাযোগের অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন।