বিশ্ব টিটিতে কলকাতার ১৫ বছরের সিন্ড্রেলা, বাড়ি ফিরে পেট ভরে ফুচকা খাব, বলল আনন্দবাজার অনলাইনকে

য়ায় অনূর্ধ্ব-১৭ টেবল টেনিসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে কলকাতার সিন্ড্রেলা দাসের লক্ষ্য বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সুইডেনে সেই প্রতিযোগিতায় নামার আগে অনুশীলনের জন্য অস্ট্রিয়া গিয়েছিল সে। মাঝে দেশে ফেরার কথা থাকলেও পাসপোর্ট সমস্যায় ফেরা হয়নি। ফলে সরাসরি সুইডেন যেতে হয়েছে ১৫ বছরের মেয়েকে। শুক্রবার থেকে সেখানে শুরু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। সুইডেনে খেলতে যাওয়ার আগে অস্ট্রিয়ার লিনজ় থেকে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলল সিন্ড্রেলা।

তবে সবার আগে মা সুস্মিতার কথা বলতে হবে। কারণ, এরকম অপরিচিত একটা নামের নেপথ্যের গল্পটা তিনিই প্রথম জানালেন। বললেন, এক বছর বয়স পর্যন্ত ওর কোনও নাম ছিল না। যার যা মনে হত সেই নামেই ডাকত। জন্মের শংসাপত্র নিতে যাওয়ার সময় একটা নাম দিতে হত। তখন সিন্ড্রেলার পিসি বলেছিলেন, ও আমাদের বাড়ির রাজকন্যা। তাই ওর নাম সিন্ড্রেলা। সেই নামটাই রাখা হয়েছে। শুধু নামের বানানে ‘সি’ এর বদলে ‘এস’। মা এবং বাবার (সুপ্রিয়) নামও ‘এস’ দিয়ে। তাই মেয়ের নামও ‘এস’ দিয়ে শুরু।

প্রশ্ন: তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য তিন দিন ধরে অপেক্ষা করে রয়েছি আমরা। শেষ পর্যন্ত মিটল পাসপোর্ট সমস্যা?

সিন্ড্রেলা: হ্যাঁ, আপাতত মিটেছে। সুইডেন থেকে ফিরে নতুন করে পাসপোর্টের আবেদন করতে হবে আবার। ক’টা দিন খুব চাপে ছিলাম। তবে অনুশীলনে কিন্তু ফাঁকি দিইনি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি চালিয়ে গিয়েছি।

sports

প্রশ্ন: খেলার জন্য তো ঘুরে বেড়াতে হয়। এ বার তো ফেরার কথা থাকলেও আসতে পারলে না। শেষ কবে বাড়ি এসেছিলে?

সিন্ড্রেলা: কী আর করা যাবে! গত মাসে দোহা থেকে এক বার বাড়িতে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন ছিলাম। তার পর ১৫ অক্টোবর গোয়া চলে গেলাম। সেখান থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে সুইডেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ হলে একেবারে বাড়ি ফিরব। ডিসেম্বরের শুরুতে।

প্রশ্ন: অনুশীলন তো নিশ্চয়ই করেছো, আর কী করলে ওই ক’টা দিন?

সিন্ড্রেলা: বই পড়তে ভালবাসি। আঁকি। সিনেমা খুব একটা দেখি না। মাঝে মাঝে ওটিটি দেখি। বাবা-মার সঙ্গে আড্ডা, গল্প তো আছেই। জানেন, আমাদের বাড়ির ছাদে না অনেক গাছ আছে। সকালে অনেক পাখি আসে। তখন আর ছাদ থেকে নামতে ইচ্ছা করে না। অনেকটা সময় কেটে যায়। আমি কুকুর, বেড়াল খুব ভালবাসি।

প্রশ্ন: আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারোনি?

সিন্ড্রেলা: আগে খুব ঘুরতে যেতাম। এখন আর অতটা হয় না।

প্রশ্ন: সত্যি কথা বল কষ্ট নিশ্চয়ই হয়?

সিন্ড্রেলা: সত্যি বলছি, এখন আর কষ্ট হয় না। ছোট থেকেই তো বাইরে বাইরে ঘুরছি। খেলার দিকেই মন থাকে।

প্রশ্ন: পুজোর সময়ও কলকাতায় থাকা হয়নি। বন্ধুরা নিশ্চয়ই ঠাকুর দেখার গল্প করেছে, ছবি পাঠিয়েছে। সেটাও খারাপ লাগেনি?

সিন্ড্রেলা: না। নতুন তো কিছু নয়। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

প্রশ্ন: পুজোয় তো নতুন জামা হয়, তা হলে?

সিন্ড্রেলা: পুজো বলে আলাদা করে কিছু কিনি না। সময় পেলেই শপিং করি। শপিং করতে খুব ভালবাসি।

প্রশ্ন: নতুন জামাগুলো পরো কখন?

সিন্ড্রেলা: খেলতে গেলে ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যাই। বিদেশে খেলা মানেই প্রতিযোগিতার শেষে ঘুরে বেড়ানো। আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন নতুন জামাগুলো একটা একটা করে পরে ফেলি।

প্রশ্ন: সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ফুচকা? আর যাই হোক, ওটা তো আর বিদেশে পাবে না?

সিন্ড্রেলা: এটা নিয়ে একটু একটু দুঃখ আছে। ফুচকা খেতে খুব ভালবাসি। কলকাতার মতো ফুচকা কোথাও পাওয়া যায় না। এ বার বাড়ি ফিরে পেট ভরে ফুচকা খাব। উফ, কত দিন যে খাইনি।

প্রশ্ন: আর বিরিয়ানি, চকলেট?

সিন্ড্রেলা: বিরিয়ানি খেতে খুব একটা ভালবাসি না। চকলেটটা ইচ্ছে হলে খাই। ওগুলো ফুচকার মতো মিস করি না।

sports

প্রশ্ন: খাওয়া-দাওয়ার তো প্রচুর বিধি-নিষেধ থাকবে। এমনিতে কী খাও?

সিন্ড্রেলা: ছোট থেকেই আমাকে একটা নির্দিষ্ট ডায়েটের মধ্যে থাকতে হয়েছে। সেদ্ধ সব্জি খাই। সকালে উঠে রাগি খাই। অনুশীলনের মাঝে ড্রাই ফ্রুট, কলা, ডিম খাই। মাছ খেতে খুব একটা ভাল লাগে না। তবে টুনা মাছ খাই। ফুচকার পর আমার প্রিয় হল মুরগির মাংস। স্ট্যু করে খাই। আবার ঝোলও খাই।

প্রশ্ন: ‘স্ট্যু করে খাই’ মানে? তুমি রান্না করতে পারো?

সিন্ড্রেলা: পারি পারি।

প্রশ্ন: বাইরে খেলতে গেলে কি নিজেই রান্না করো?

সিন্ড্রেলা: না না। সেটার দরকার হয় না। দলের সঙ্গে থাকলে রান্না করার লোক থাকেন। বাইরে একা অনুশীলন করতে গেলে যেখানে থাকি সেখানেও রান্নার ব্যবস্থা থাকে। কখনও কখনও ইচ্ছে হলে নিজে রান্না করে নিই।

প্রশ্ন: আর পড়াশোনা? সমস্যা হয় না?

সিন্ড্রেলা: আমি ঠিক সময় বার করে নিজের পড়া করে নিই।

প্রশ্ন: এখন তো বারাসতের স্কুলে পড়? আগে অন্য স্কুলে পড়তে। সেটা কি পড়াশোনার সুবিধার জন্য?

সিন্ড্রেলা: একেবারেই। আগে আইসিএসই স্কুলে পড়তাম। ওখানে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে খুব কড়াকড়ি ছিল। এখন সিবিএসই স্কুলে স্পোর্টস কোটায় ভর্তি হয়েছি। তাই খেলতে গেলে কোনও সমস্যা হয় না। অ্যাটেনডেন্সের কড়াকড়ি নেই। শুধু পরীক্ষায় বসলেই হয়ে যায়। এমনকী পরীক্ষার সময় যদি খেলা থাকে, তা হলে ফিরে এসে পরীক্ষা দিই।

প্রশ্ন: এ বার কিন্তু একটা কঠিন প্রশ্ন আছে।

সিন্ড্রেলা: কী?

প্রশ্ন: কে বেশি কাছের? বাবা, না মা?

সিন্ড্রেলা: এই রে! সত্যিই এটা বলতে পারব না। বাবা-মা ৫০-৫০। কোচদেরও খুব ভালবাসি।

sports

প্রশ্ন: খেলা ছাড়া আর কী কী করতে ভালবাসো?

সিন্ড্রেলা: আমি ছোটবেলায় গান, নাচ, আঁকা, সাঁতার সব কিছু করতাম। এখনও আঁকি। আঁকতে খুব ভালবাসি। সময় পেলেই আঁকি। আমি কিন্তু খুব ভাল আঁকি। সাঁতার কাটতেও খুব ভাল লাগে। সুইমিং পুল দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি। নাচ, গানটা আর করা হয় না।

প্রশ্ন: আচ্ছা, একটা কথা বলো তো। এত খেলা থাকতে হঠাৎ টেবল টেনিসে এলে কেন?

সিন্ড্রেলা: কী জানি! ছোটবেলায় বাঘাযতীনে বাড়ির পাশে একটা ক্লাবে টেবল টেনিস খেলতাম। তখন সত্যিই ভাবিনি এটাই খেলব। খেলতে ভাল লাগত। তার পর এক দিন একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তাতে ছেলেদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তার পর থেকে টেবল টেনিস আরও ভালবেসে ফেললাম।

প্রশ্ন: এ বার একটু খেলার কথায় আসা যাক। তোমার কেউ আদর্শ আছেন?

সিন্ড্রেলা: কোনও এক জনের নাম আলাদা করে বলতে পারব না। ভারতীয়দের মধ্যে অবশ্যই আমার কোচ সৌম্যদীপ (রায়) স্যর ও পৌলমী (ঘটক) ম্যাম। তা ছাড়া মৌমা দাস ও শরথ কমলের খেলা খুব ভাল লাগে। বিদেশিদের মধ্যে আমি ওয়াং মানিউর ভক্ত।

প্রশ্ন: কলকাতায় থাকলেও সত্যিই কি ছুটি পাও? অনুশীলন থাকে তো?

সিন্ড্রেলা: আমাদের অ্যাকাডেমিতে (ধুনসেরি ধানুকা সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি) পাঁচটা করে সেশনের পর একটা করে সেশন ছুটি থাকে। সোমবার সকাল, বিকাল, মঙ্গলবার সকাল, বিকাল আর বুধবার সকালে অনুশীলন করি। সে দিন বিকালে ছুটি। আবার বৃহস্পতিবার সকাল, বিকাল, শুক্রবার সকাল, বিকাল আর শনিবার সকালে অনুশীলন করি। শনিবার বিকালে ছুটি। রবিবার পুরো ছুটি থাকে।

sports

প্রশ্ন: তোমার খেলার ধরন কী?

সিন্ড্রেলা: আমি আক্রমণাত্মক স্ট্রোক খেলতে ভালবাসি। আমার সার্ভিস ভাল। চেষ্টা করি প্রথম কয়েকটা শটের মধ্যেই পয়েন্ট জিতে নিতে।

প্রশ্ন: আর দুর্বলতা? সেটাও তো নিশ্চয় আছে? কী ভাবে উন্নতি করার চেষ্টা করো?

সিন্ড্রেলা: যে দিন যে শটটা খারাপ হয় সেটা ডায়েরিতে লিখে রাখি। পরে কোচের সঙ্গে সেই শট নিয়ে আলোচনা করি। সেটা কী ভাবে ভাল খেলব তার চেষ্টা করি।

প্রশ্ন: সৌম্যদীপই তো তোমার প্রথম কোচ?

সিন্ড্রেলা: স্যরই আমাকে হাতে ধরে সব কিছু শিখিয়েছেন। পৌলমী ম্যামও অনেক সাহায্য করেন। বিদেশে আমরা খেলতে গেলে স্যর অনেক সময় যান। ওঁর সঙ্গে সব সময় কথা হয়। ধানুকা স্যর (ধুনসেরি ধানুকা সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমির কর্ণধার চন্দ্রকুমার ধানুকা) আমাদের বিদেশে অনুশীলন করতে পাঠান। ওঁরা না থাকলে এতটা এগোতে পারতাম না।

প্রশ্ন: ঐহিকাদি (মুখোপাধ্যায়) আর সুতীর্থাদি (মুখোপাধ্যায়) তো একই অ্যাকাডেমির। কথা হয়?

সিন্ড্রেলা: নিশ্চয়ই। ঐহিকাদি আর সুতীর্থাদির সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমরা আসলে সব বন্ধুর মতো। নিউটাউনে আমাদের নতুন অ্যাকাডেমিতে আমরা তিন জন একই ঘরে থাকি। আমরা রুমমেট। ওরা অনুশীলনের সময় অনেক পরামর্শ দেয়। দেখেছি যে ওরা কী ভাবে সারা দিন কাটায়। বাড়িতে থাকলে যা করে হস্টেলেও তা-ই করে। ঐহিকাদি তো নিয়ম করে ধ্যান করে। এটা আমার খুব ভাল লাগে।

প্রশ্ন: আসল লক্ষ্য তো নিশ্চয় অলিম্পিক্স?

সিন্ড্রেলা: হ্যাঁ, ২০২৮ সালের অলিম্পিক্সে খেলতে চাই। তার আগে ২০২৬ সালের কমনওয়েলথ গেমসেও খেলতে চাই। তবে তার জন্য আমাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে। সবার আগে সুইডেনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশে ফিরতে চাই।

প্রশ্ন: জিতে ফেরো, তার পর তো বাড়ি ফিরে ফুচকা খেতে হবে?

সিন্ড্রেলা: হ্যাঁ, অনেক দিন খাইনি। পেট ভরে ফুচকা খাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.