কথায় আছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু এই ‘চোর’ তিন-তিন বার চোখে ধুলো দিয়ে পালালেও টনক নড়েনি পুলিশের। বাগে আনতে গোয়েন্দাদের হাজারও ফন্দিফিকির তার কাছে নস্য! দু’বার তার অজুহাত ছিল ‘শারীরিক অসুস্থতা’। আর শেষ বার তো সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে সে। কোমরের দড়ি কেটে কারারক্ষীদের নজর এড়িয়ে জেল থেকে পালিয়েছে বিহারের এই কুখ্যাত দুষ্কৃতী। সম্প্রতি কলকাতার উপকণ্ঠে দুঃসাহসিক ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্ত সেই দুষ্কৃতীকে ধরতে আবারও ওৎ পেতেছে লালাবাজারের গুন্ডাদমন শাখা।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। বেলেঘাটার সুরাহা ইস্ট রোডের গীতাঞ্জলি আবাসনের তিন তলায় কোয়েল মুখোপাধ্যায় নামে আইনজীবীর ফ্ল্যাটে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। মূলচক্রী হিসেবে উঠে আসে আইনজীবীর স্বামীর নাম। তিনিও পেশায় আইনজীবী। পুলিশ সূত্রে খবর, পারিবারিক মতানৈক্যের জেরে আলাদা থাকতেন দম্পতি। অভিযোগ, স্ত্রীর উপর প্রতিশোধ নিতে চার ভাড়াটে গুন্ডাকে দিয়ে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন তিনি। ভরসন্ধ্যায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে ওই দুষ্কৃতী-তাণ্ডবের ঘটনায় মহানগরীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
তদন্ত নেমে কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখা ৩ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রেশ্বর মাহাতো ও রাজকুমার রাই নামে বিহারের দুই কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে মুজফফরনগর থেকে গ্রেফতার করে। ধৃতদের নিয়ে আসা হয় শহরে। কলকাতা পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন রাজকুমার জানায়, তার শরীর খারাপ। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল ভর্তি করানো হয়। মে মাসে ওই হাসপাতাল থেকে প্রথম বার পালায় রাজকুমার। আবার তার খোঁজে শুরু হয় তল্লাশি।
কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখা সূত্রে খবর, জুন মাসে তদন্তকারীরা খবর পান, রাজকুমার নেপালে গা ঢাকা দিয়েছেন। তার কিছু দিন পরেই আবার খবর আসে, অন্য একটি মামলায় বিহারের মতিহারি থেকে রাজকুমার গ্রেফতার হয়েছে। মতিহারি থেকে মুজফফরপুর আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকেও বিহার পুলিশের চোখে ধুলে দিয়ে পালায় সে। পরে অগস্ট মাসে আবার রাজকুমারকে গ্রেফতার করা হয় মতিহারির গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ডাকাতির অভিযোগে। এই খবর পেয়েই মতিহারি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় লালবাজারের তরফে। কলকাতা পুলিশের আট জনের একটি দল মতিহারিতেও যায়। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন জানিয়ে সেই সময় রাজকুমারকে কলকাতা পুলিশের হাতে তুলে দেয়নি মতিহারি পুলিশ। খালি হাতেই ফিরতে হয় লালবাজারের গোয়েন্দাদের।
বিহার পুলিশের এক সূত্র জানায়, মতিহারি পুলিশের কব্জায় থাকাকালীনও এক বার পালানোর চেষ্টা করেছিল রাজকুমার। অসুস্থতার ভান করে একই কায়দায় হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় সে। সেই মতো স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। কিন্তু বিহার পুলিশের তৎপরতায় রাজকুমারের হাসপাতাল থেকে পালানোর ছক বানচাল হয়ে যায়।
এর পর ৮ অগস্ট মতিহারি জেলে পাঠানো হয় কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে। সেখানে তার নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয় হোমগার্ড বলিরামপ্রসাদ যাদব ও রামন বৈঠার উপর। রাজকুমারের কোমরে দড়িও পরানো হয়। কিন্তু তা যে যথেষ্ট ছিল না, তা প্রমাণ হয়ে গেল ১৪ অগস্ট। বেলা ২টোর সময় দুই হোমগার্ডের ডিউটি বদলের সময় সুযোগ দেখে দড়ি কেটে জেলে থেকে পালায় রাজকুমার। ইতিমধ্যেই ওই দুই নিরাপত্তীরক্ষীর বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেছে বিহার পুলিশ। পূর্ব চম্পারন জেলার পুলিশ সুপার আশিস কুমার বলেন, ‘‘রাজকুমার কী ভাবে পালাল, তা তদন্ত করে দেখার জন্য জেল সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে আবার গ্রেফতার করতে সব রকম ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।’’
গত ছ’মাসে তিন বার পুলিশের ঘেরাটোপ থেকে কুখ্যাত দুষ্কৃতীর পালানোর ঘটনায় ‘বিরক্ত’ আইনজীবী কোয়েলও। পুলিশের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘‘আমি স্তম্ভিত। বার বার এ রকম এক জন কুখ্যাত দুষ্কৃতী কী ভাবে পুলিশ হেফাজত থেকে পালায়, বুঝতে পারছি না।’’
তবে এ বার আর কোনও ফাঁকফোকর রাখতে চাইছে না কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখা। পুলিশ সূত্রে খবর, রাজকুমারকে বাগে আনার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিহার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বাংলা, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের গোপন সূত্রদেরও কাজে লাগিয়েছেন গোয়েন্দারা। যোগাযোগ করা হয়েছে নেপালের পুলিশের সঙ্গেও। লালবাজারের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘অভিযুক্ত অন্তঃরাজ্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত গ্রেফতার করা হবে ওকে।’’ তবে এক প্রবীণ কর্তা রসিকতার সুরে বলেন, ‘‘বাগে আনতে পারলেও কত ক্ষণ তাকে আটকে রাখা যাবে, তা একমাত্র রাজকুমারই জানে।’’