কাঞ্চনের ৬ লক্ষ টাকার বিল বিধানসভার ২৮ বছর আগের স্মৃতি ফেরাল! সে ঘটনা গড়ায় বহিষ্কার পর্যন্ত

বিধানসভায় বিধান প্রণয়ন বা আইন পরিবর্তনের ‘বিল’ নিয়েই শুধু বিতর্ক হয় না! বিধায়কদের জমা করা মেডিক্যাল বা চশমার ‘বিল’-ও নানা জমানায় বিতর্ক বা আলোচনার লহর তুলেছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিকের দেওয়া ৬ লক্ষ টাকার মেডিক্যাল বিল। এই বিলের খবর শুনে প্রবীণদের অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে ২৮ বছর আগের একটি ঘটনা। সেই ঘটনাও একটি মেডিক্যাল বিলকে কেন্দ্র করে। জল গড়িয়েছিল বিধায়কের বহিষ্কার পর্যন্ত। যদিও সে ক্ষেত্রে ভুয়ো বিল জমা দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। কাঞ্চনের ক্ষেত্রে এমন কোনও অভিযোগ এখনও ওঠেনি।

৯০-এর দশকে আসানসোল শিল্পাঞ্চলের যুবনেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন শ্যামাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘সৎ-নির্ভীক’ বলে পরিচিত নেতাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৮০টির বেশি আসনে জয়লাভ করে কংগ্রেস। হিরাপুর (বর্তমানে অবলুপ্ত) বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট সমর্থিত জনতা দলের প্রার্থী মমতাজ হোসেনকে হারিয়ে বিধানসভায় পা রেখেছিলেন কংগ্রেস নেতা শ্যামাদাস। সেই সময় কংগ্রেস পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক ছিলেন আব্দুল মান্নান। নিজের পুরোনো স্মৃতি থেকে প্রবীণ নেতা বলছেন, ‘‘শ্যামাদাস উঠতি দাপুটে নেতা হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু ভোটে জেতার পর ধীরে ধীরে তাঁর জীবনশৈলী কী ভাবে বদলে গিয়েছিল তা আমাদের মত বিধায়কেরা দেখেছিলাম। এক জন লড়াকু নেতাকে ধীরে ধীরে আভিজাত্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে দেখে সেই সময় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।’’ সে সময় শ্যামাদাসের জীবনযাপন প্রসঙ্গে কংগ্রেস বিধায়কেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা অতীশ সিংহের কাছেও।

বিধায়ক শ্যামাদাস ঘনঘন মেডিক্যাল বিল জমা দিতে শুরু করেন বিধানসভায়। সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে বিধানসভার সচিবালয়ে। একবার ডাক্তার দেখানোর এবং ওষুধের ‘বিরাট’ অঙ্কের বিল জমা দেন বিধানসভায়। সেই ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায় সংবাদমাধ্যমে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে তৎকালীন স্পিকার হাসিম আবদুল হালিম তদন্তের নির্দেশ দেন। ধরা পড়ে, ভুয়ো ডাক্তার এবং ওষুধের ভুয়ো দোকানের বিল জমা দিয়েছিলেন শ্যামাদাস। স্পিকার হালিম জানতে পারেন, ডাক্তারখানার যে ঠিকানা বিলে দেওয়া হয়েছে তা আসানসোলের একটি কাপড়ের দোকানের। আর যে ওষুধের দোকানের নাম দেওয়া হয় তার কোনও অস্তিত্বই নেই আসানসোল শিল্পাঞ্চলে।

তদন্ত করে খতিয়ে দেখার পর স্পিকার হালিম বিষয়টি জানান কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতাদের। তৎকালীন এক কংগ্রেস বিধায়ক জানাচ্ছেন, তাঁদের তরফে স্পিকারকে বলা হয়েছিল, নিজের ক্ষমতাবল ব্যবহার করে হালিম তাঁর বিধায়কপদ খারিজ করলে করুন। কিন্তু শ্যামাদাসের বিরুদ্ধে যেন কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা না-নেওয়া হয় সেই অনুরোধও করা হয়েছিল। কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সেই অনুরোধ মেনে শ্যামাদাসের বিধায়কপদ খারিজ করেই ছেড়ে দেন হালিম। সেই ঘটনার পর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকেন আসানসোলের কংগ্রেস নেতা। বর্তমানে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন তিনি। আসানসোলে নিজের মেয়ের কাছে থাকেন।

বিধানসভায় জমা দেওয়া আরও অনেক বিল নিয়েই বিতর্ক হয়েছে অতীতে। তবে শ্যামাদাসের বহিষ্কারের ঘটনা নজিরবিহীন। যে সংবাদের সূত্রে শ্যামাদাস-স্মৃতি ফিরল, সেই কাঞ্চন-বিল প্রকাশ্যে এসেছে মঙ্গলবার। সম্প্রতি কাঞ্চনের স্ত্রী শ্রীময়ী কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সন্তান প্রসবের মেডিক্যাল বিল ৬ লক্ষ টাকা। রাজ্য তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা দলীয় মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বুধবার অবশ্য দাবি করেছেন, কাঞ্চন বিল জমা দেওয়ার বিষয়ে খোঁজখবর নিলেও, বিল জমা দেননি এখনও। নিজের এক্স হ্যান্ডলে কুণাল লিখেছেন, ‘‘বিধায়করা বিধানসভা থেকে মেডিকেল বিল পান। এটা নিয়ম বহির্ভূত নয়।… ছ’লক্ষ টাকার বিল নিয়ে কাঞ্চন বিধানসভায় খোঁজ নিয়েছেন উনি জমা দিতে পারেন কিনা। আলোচনা করেছেন। নিয়ম জেনেছেন। কিন্তু বিল জমা দেননি।’’

বিধানসভা সূত্র অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। কাঞ্চন বিল জমা দিয়েছেন মঙ্গলবারেই। তবে বিধানসভার তরফে কাঞ্চনের বিল গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু ঔপচারিকতা বাকি রয়ে গিয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার কাঞ্চনকে আরও কিছু নথি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে বিধানসভার ‘টিএ-ডিএ সেকশন’-এ। কাঞ্চনের বিলের সঙ্গে কেউই অবশ্য শ্যামাদাসের সেই ভুয়ো বিলের তুলনা টানছেন না। তিনি যে বিল জমা দিয়েছেন তা কলকাতার একটি পরিচিত বেসরকারি হাসপাতালের এবং এক পরিচিত চিকিৎসকের ইউনিটের। তবে বিলের অঙ্ক অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ঠেকেছে। কাঞ্চন নিজে এই বিল সম্পর্কে কিছু জানাতে চাননি। মঙ্গলবার তিনি টেলিফোনে বলেন, ‘‘আপনারা যেখান থেকে বিলের ব্যাপারে জেনেছেন, সেখান থেকেই বাকি বিষয়টি জেনে নিন।’’

বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় কাঞ্চনের বিলের প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিল ছাড়পত্র দেওয়ার আগে আমি নিজে সব দেখি। এ ক্ষেত্রেও আমি নিজেই সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখব। তার পর যদি কোনও প্রশ্ন দেখা দেয় তা হলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলব।’’ তৃণমূলের এক প্রাক্তন বিধায়কের কথায়, ‘‘স্পিকার চাইলে ওই বেসরকারি হাসপাতালে কর্তৃপক্ষকে বিধানসভায় ডেকে পাঠাতে পারেন। সংবিধান ও আইন সেই ক্ষমতা স্পিকারকে দিয়েছেন। তাই বিলটি অনুমোদন দেওয়ার আগে তিনি এই সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত করে দেখতেই পারেন।’’

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়কেরা মূল বেতন এবং একাধিক ভাতা মিলিয়ে মাসে এক লক্ষ ২১ হাজার টাকা পান। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাও দেওয়া হয় তাঁদের। অতীতেও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় স্বাস্থ্য বিষয়ক বিল নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন মন্ত্রী-বিধায়কেরা। বামফ্রন্ট জমানায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর মন্ত্রিসভার এক সদস্য মানব মুখোপাধ্যায় চশমার জন্য ৩০ হাজার টাকা দাবি জানিয়েছিলেন বিধানসভার কাছে। তা নিয়ে এতটাই বিতর্ক হয় যে, শেষ পর্যন্ত তিনি বরাদ্দ অর্থ নেননি। ২০১১ সালে পরিবর্তনের সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও বিতর্ক হয়েছে। তৎকালীন নারী-শিশু ও সমাজকল্যাণ উন্নয়ন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র চশমার জন্য এক লক্ষ টাকার বিল জমা দেন। তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে তিনি টাকা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। দাবি করেন, ভুলবশত এমন বিল হয়ে গিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.