এমন কালীর কথা সম্ভবত ভূ-ভারতেও কেউ শোনেনি। কালীকে ‘মা’ বা ‘মেয়ে’ হিসেবে বহুজনই যুগে যুগে কল্পনা করেছেন, সেই মতো ভজনা করেছেন, সিদ্ধি লাভও করেছেন। কিন্তু কালীকে ননদরূপে ভজনা? না, সম্ভবত কেউ কখনও এমন সাধনরীতির কথা শোনেনি, সাধন করা তো দূরের কথা। সেই আশ্চর্য জিনিসই ঘটেছে নদিয়ায়, কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগরের সাহাবাড়িতে। এই বাড়িতে মা ভবতারিণী, কৃষ্ণনগর সাহাবাড়ির মেয়ে, গত ৩৫ বছর ধরে সাহাবাড়ির পুত্রবধূর ননদ হিসেবে পূজিতা হন তিনি! বাড়ির মেয়ে ভবতারিণী কালীমা বাড়ির বউমার ননদ হিসেবে থাকেন কৃষ্ণনগর রথতলা সাহাবাড়িতে।
‘ননদ’ হিসেবে থাকেন এই কালী, তাই হয়তো ‘ননদকালী’ বলাই চলে এঁকে। ভবতারিণীকে সকালে দাঁত মাজার জন্য ব্রাশ-মাজন দিতে হয়। না দিলেই রাগ হয়ে যায় মেয়ের। তারপর খাওয়া-দাওয়া তো দিতেই হয়। তা-ও চাল-কলা-ফল-মূল-বাতাসা নয়। দিতে আধুনিক ফাস্টফুড চকোলেট-সহ নানা কিসিমের খাবার। দিতে হয় নবদ্বীপের লাল দইও। ‘ননদকালী’র এই পুজোয় লাগে আধুনিক জুতো, ফ্যাশনেবল ভ্যানিটি ব্যাগ, ট্রেন্ডি সুগন্ধি, বডি স্প্রে’র মতো সাজগোজের সব জিনিসপত্র। বাড়ির ছেলের বউকে সোনার গয়না দিলে, ভবতারিণী কালীকেও তা দিতে হয়। না দিলে নিজের মা-বাবার কাছ থেকে তা চেয়ে নেন কালী। কালীমেয়েকে প্রতি সপ্তাহে নতুন শাড়িও পরাতে হয়, দিতে হয় পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ-করা অ্য়াকসেসরিজ। মন্দিরেই রাখা থাকে সব কিছু। বাড়ির বউমা সোমার সঙ্গে খুনসুটিও হয় কালীর। বাড়ির বৌমাও বলেন, বৌদি-ননদের সম্পর্ক আমাদের। ননদকালী ভবতারিণী বৌদিকে বলেন– তোকে বাবা এই সব দিয়েছে, আমাকে দেয়নি, আমাকেও দিতে হবে!
দিতে তো হয়ই। সবই দিতে হয়। কেননা এই ননদ তো আর দেবী নন, দেবী হিসেবে তো বাড়িতে থাকেন না তিনি। থাকেন একেবার ঘরের মেয়েটির মতোই। তা, ঘরের মেয়ের অভিমান হলে, কে না তা ভাঙায়?
সারা বছরই পুজো হয় এই ভবতারিণীর। বৈশাখ মাসের অমাবস্যায় মূর্তি পরিবর্তন হয়। জলে বিসর্জন দেওয়া নিষেধ। তাই কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপে গিয়ে প্রতীকী বিসর্জন দিয়ে ওই দিনেই নতুন প্রতিমা আনা হয় বাড়িতে। আর কালীপুজোয় তো তাঁর বিশেষ ভাবে পুজো হয়। পুজো হয় দিনের বেলায়।
৩৫ বছর আগে স্বপ্নে এই কালো মেয়ে ভবতারিণী বাড়িতে এসেছিলেন। বাড়ির গিন্নি জয়ন্তী সাহার বিছানায় শুয়ে পড়ে তাঁকে মা বলে ডাকেন তিনি। জয়ন্তী নাকি বলেছিলেন, এই কালো মেয়েকে তিনি নেবেন না! তবুও সেই মেয়ে জোর করে থেকে যায়, দাবি জয়ন্তীর।