প্রিয়দর্শী মজুমদার, সঞ্চিতা অধিকারী ও সন্দীপ দে
দুর্গাপুজো আর লক্ষ্মীপুজো তো এবাবের মতো শেষ, আসছে কালীপুজো| আর কে না জানে যে দোলে যেমন আবির আর রঙের খেলা, বিশ্বকর্মা পুজোয় যেমন পেটকাটি-চাঁদিয়াল ঘুড়ির খেলা, ঠিক তেমনই কালীপুজো মানেই নানারকম আলো আর শব্দবাজির খেলা|
দুর্গাপুজোয় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখে (প্যান্ডেল হপিং) সময় কেটে যায় কিন্তু কালীপুজোয় শুধু ঠাকুর দেখলেই হবে না, সঙ্গে অবশ্যই চাই বাজি| সেই বাজি পোড়ানোর আগে একটু সংক্ষেপে এর ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক|
ভারতে এই আলো ও শব্দ বাজির খেলা বহু প্রাচীন| ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দী এবং পরবর্তীকালে মুঘল আমলেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়| তবে ভারতে সংগঠিতভাবে বাজির কারখানা প্রথম তৈরি হয় আরও কয়েক শতক পরে; উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায়| আগে মূলত তামিলনাড়ুর শিবকাশী ও কলকাতা-হাওড়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই বাজি তৈরি হত। তবে উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বর্তমানে ভারতের আরও একাধিক জায়গাতেই বাজির কারখানা গড়ে উঠেছে|
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটা তো শুনলেন, এবার তবে বলি সামান্য একটু বিজ্ঞানের কথা| বাজির আলো ও শব্দের পিছনে লুকিয়ে আছে রসায়নের ভেলকি| রসায়নের ফর্মুলা মেনে তৈরি হয় বাজির মশলা| বিভিন্ন জাতের বাজির বিভিন্ন রকম মশলা| কতটা জোরে শব্দ হবে, কী পরিমাণে বা কতদূর পর্যন্ত আগুনের ফুলকি ছড়াবে, সেই সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক অনুপাতে মশলার মিশেল এবং নির্দিষ্ট আঁধারের মধ্যে বাজির মশলার প্যাকেজিং| বিভিন্ন মশলার মিশেলের ভুল অনুপাত ও প্যাকেজিং সুনির্দিষ্ট না হলে সেই বাজি যে শুধু কাজ করবে না তাই নয়, এর ফলে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে| তাই এই ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানতা জরুরি|
কোনও ইলেকট্রনিক গ্যাজেট যেমন তড়িৎ সংযোগের আগে পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকে, একটি সঠিকভাবে নির্মিত বাজি ও তেমনই অপেক্ষা করে পলিতায় অগ্নি সংযোগের| একবার আগুন দেওয়ার পরেই বাজির খেলা শুরু| রসায়নের সূত্র মেনে সেই বাজি থেকে হয় পাওয়া যাবে শব্দ, নয়তো আলো অথবা দুটোই একসঙ্গে|
ইলেকট্রনিক্সের সূত্র মেনে তৈরি গ্যাজেটের সঙ্গে রসায়নের সূত্র মেনে তৈরি বাজির মূল পার্থক্য হল, এগুলি কেবলমাত্র একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি, যেখানে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সুইচ চালিয়ে বা বন্ধ করে অসংখ্যবার ব্যবহার করা সম্ভব| তবে বর্তমানে আধুনিক প্রজন্মের বাজিতে ইলেকট্রনিক্সেরও প্রয়োগ দেখা যায়| এল.ই.ডি. নির্ভর বাজিগুলো এই শ্রেণির| এই জাতীয় বাজিগুলির পোশাকি নাম বৈদ্যুতিন বাজি| যেহেতু এই বাজিগুলো আগুনের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক সুইচ দ্বারা চালিত হয়, তাই এদের একাধিক বার ব্যবহার করা চলে|
বাজির ইতিহাস বা বিজ্ঞান জানার পর এবার একটু জেনে নিই, কারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত| দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাম্পাহাটি, নুঙ্গির বাজির কারখানা| অসংখ্য শিল্পী এই কাজের সঙ্গে যুক্ত| তবে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত বিবিধ সরকারি বিধিনিষেধের কারণে চিরাচরিত বাজির ব্যবসা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। কেউ কেউ অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন| দূষণ পর্ষদের নিয়ম মেনে বাজিও তৈরি করা হচ্ছে।
বাজি কেনার টিপস
যেখান থেকেই কিনবেন, অবশ্যই সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত বাজিই কিনবেন| আনন্দের উৎসব যেন আতঙ্কের উৎসবে পরিণত না হয়ে এই ব্যাপারে সবার ভূমিকাই জরুরি| বাজি ফাটানোর সময় অবশ্যই প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করুন। হাতের কাছে ফার্স্ট এইড সংক্রান্ত জরুরি জিনিসপত্রগুলি রেখে দিন এবং আপনার আনন্দ যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখুন| ছাদ বা উঠোন যেখানেই বাজি পোড়ান, সবশেষে জায়গাটা পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্বও আপনারই|
————————————————————————–
(লেখকদের মতামত ব্যক্তিগত)
প্রিয়দর্শী মজুমদার ও সন্দীপ দে কলকাতার ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইলেকট্রনিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক|
সঞ্চিতা অধিকারী কলকাতার জ্যোতিনগর বিদ্যাশ্রী নিকেতন ( উ.মা.) গভর্নমেন্ট স্পন্সরড স্কুলের শিক্ষিকা|