বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায় ( জন্ম: ১ ডিসেম্বর, ১৯৩৩, মৃত্যু: ১৭ এপ্রিল, ২০২১ ) গত পরশু রাত ১১ টায় কলকাতায় অ্যাপোলো হাসপাতালে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল – ৮৭ বছর। ১৯৯৯ সালে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একটি ঐতিহাসিক জনস্বার্থ মামলার সূত্রে বিচারপতি প্রভাশঙ্কর মিশ্র, ও বিচারপতি ভাস্কর ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের অন্তর্ধান রহস্যের পুনর্তদন্তের আদেশ জারী করেন। সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্রী মনোজ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। বিচারপতি মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন এই তদন্ত কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ছিল – ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল – প্রায় ৫ বছর। বিগত দুই টি কমিশনের ( শাহন ওয়াজ কমিটি, ও বিচারপতি খোসলা কমিশন ) মতো কার্যপদ্ধতি অনুসরণ না করে বিচারপতি মুখার্জী তাঁর কমিশনের full team সহ তাইওয়ান, রাশিয়া, জাপান, জার্মানী, ব্রিটেন, — দেশ গুলি visit করেন, সব documents, files পর্যবেক্ষণ করেন, ও বিগত কমিশন গুলির মত ঘরে বসে তদন্ত করে রিপোর্ট না লিখে সরেজমিনে গিয়ে documents ও sites পর্যবেক্ষণ ও তদন্তের ওপরেই জোর দেন। তাঁর submit করা ঐতিহাসিক JMCI ( Justice Mukherjee Commission of Inquiry ) report – এ প্রতিফলন ঘটে এক ঐতিহাসিক সত্যের। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগষ্ট, তাইহোকু বিমান ক্ষেত্রে কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি, বা সেই দরুণ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের মৃত্যুও ঘটেনি। ৬০ বছরের দীর্ঘ মিথ্যের মিথ ভেঙে যায়! ২০০৬ সালে ভারত সরকারের ক্যাবিনেট এই রিপোর্টের ওপর ATR – এ ( Action Taken Report ) এই বিচারপতি মুখার্জী কমিশনের রিপোর্টের প্রতি অসহমতি প্রকাশ করে, এবং সংসদে সরকারের পছন্দসই না হওয়া এই রিপোর্ট কে বস্তুত খারিজ করে। কিন্তু বিচারপতি মুখার্জী এই ঐতিহাসিক সত্য কেই সামনে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন যা তাঁর পূর্বসূরীরা পারেন নি, বা চেষ্টাও করেন নি।
বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায় সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি থাকার সময়ে বিশিষ্ট শিল্পী, চিত্র পরিচালক – নির্দেশক ও লেখক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের একনিষ্ঠ অনুরাগী – শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষ দিল্লী তেই ছিলেন। সেই সময় দিল্লী তে ‘ ভারত পথিক ‘ নামে একটি সংগঠন নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের ওপর কাজ করত। শ্রী ঘোষ সেই সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন। অনেক অনুষ্ঠানেই বিচারপতি দের তাঁরা আমন্ত্রণ জানাতেন। সেই সূত্রেই সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি থাকা কালীন বিচারপতি মুখার্জীর সঙ্গে ভারত পথিক সংগঠনের তরফে শ্রী ঘোষের যোগাযোগ হয়। বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায় বম্বে ও এলাহাবাদ হাই কোর্টের মুখ্য বিচারপতি ছিলেন। উনি স্বনামধন্য ক্রিমিনাল আইনজীবী ছিলেন। জীবনের শুরু তে উনি আসানসোলে আইনজীবী হিসাবে প্র্যাক্টিস করতেন। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে অবসরের পর তাঁকে নিয়োগ করা হয় নেতাজী ইনকোয়ারি কমিশনের চেয়ারপার্সন হিসাবে। বিচারপতি মুখার্জী তাঁর এই কমিশনের অন্য deponent দের অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তের ক্ষেত্রে কিছু important points শিখিয়ে দিয়ে যান। অধ্যাপক নন্দলাল চক্রবর্তী কমিশনের সেই দিন গুলির স্মৃতি চারণা করতে গিয়ে বলেছেন – বিচারপতি মুখার্জী তাঁদের বলতেন – ” কোনো ব্যক্তির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসাবে যে দুটো ব্যাপারের কোনো গুরুত্ব নেই, সেটা হল – speculation ( আন্দাজ ), ও hearsay ( কানে শোনা কথা বার্তা ) ।
বিচারপতি মুখার্জী কমিশনের তদন্ত চলাকালীন চিত্র পরিচালক শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষ একটি documentary করছিলেন। সেই ‘ Black Box of History ‘ নামে ডকুমেন্টারি করার সময়ে নেতাজীর সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের সাথেই শ্রী ঘোষ যোগাযোগ করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তখন বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের সাথে যোগাযোগ হয়। সেই সময়ে বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের বিধান নগরের বাড়ীতে দীর্ঘ সময় interview নেওয়ার সুযোগ শ্রী ঘোষের হয়। বিচারপতি মুখার্জী কমিশনের গঠন থেকে রিপোর্ট জমা দেওয়া পর্যন্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘ কথা হয়। আলোচনার মধ্যেই অবকাশের সময়ে বিচারপতি মুখোপাধ্যায় অনেক কথা ‘ অফ্ দ্য রেকর্ড ‘ বলেন। সে সময় উনি বলেন – ” আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি ১০০% বিশ্বাস করি যে ফৈজাবাদের গুমনামী বাবাই ছিলেন নেতাজী “। এই কথাটা রেকর্ড হয়েছিল এবং শ্রী ঘোষ অনেক চিন্তা করার পর ডকুমেন্টারি তে এই অংশ টা রেখেছিলেন। ডকুমেন্টারি রিলিজ হওয়ার পর গোটা ভারতে তোলপাড় পড়ে যায়! কেননা, বিচারপতি মুখোপাধ্যায় কমিশনের রিপোর্টে ‘ পয়েন্ট অফ্ রেফারন্সে ‘ স্পষ্টই বলেছিলেন ১৯৪৫ সালের ১৮ আগষ্ট তাইহোকু তে কোনো বিমান দুর্ঘটনা হয় নি। ফলে মৃত্যুর কোনো প্রশ্নই উঠছে না। কিন্তু মানুষের আয়ু যদি গড় ৮০ বছর হয়, তবে রিপোর্ট ২০০৫ সালে জমা দেওয়ার সময় নেতাজীর বয়স দাঁড়াচ্ছে ১০৮ বছর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিচারপতি মুখার্জীর মত অনুযায়ী তাঁর বেঁচে থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বিচারপতি মুখার্জী আবার অফ্ দ্য রেকর্ড ফৈজাবাদের গুমনামী বাবাই নেতাজী বলায় গোটা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়!
পশ্চিমবঙ্গের তখনকার একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষের সাক্ষাৎকার নেয়। তা গোটা ভারতে সম্প্রচারিত হয়। শ্রী ঘোষ গোপন আলোচনা প্রকাশ করেছিলেন বলে বিচারপতি মুখোপাধ্যায় তাঁর ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি কোনো বিষয় অস্বীকার করেন নি। উনি স্পষ্টই বলেছিলেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন না, তবে শ্রী ঘোষ প্রকাশ করেছিলেন বলে উনি বিষয়টি কে unethical বলেছিলেন। কিন্তু শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষ মনে করতেন – নেতাজী রহস্য উন্মোচনের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো ‘ double face ‘ থাকা উচিত নয়।
নেতাজী নিয়ে যে রহস্য রয়েছে, তা উন্মোচনে উনি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগষ্ট, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার যে তত্ত্ব ও এই সংক্রান্ত গল্প কে grand narrative দেওয়া হয়ে আসছে, তাকে তিনি যুক্তি ও তথ্য দিয়ে নস্যাৎ করেছিলেন। বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের জীবনের এটাই সবচেয়ে বড় কীর্তি। কিন্তু একটাই প্রশ্ন থেকে যায় – ‘ বিচারপতি মুখোপাধ্যায় নির্ভীক বিচারপতি হলেও কেন জনসমক্ষে বলতে পারলেন না যে তিনি ১০০% বিশ্বাস করেন ফৈজাবাদে র গুমনামী বাবা, শ্রী ভগবানজীই নেতাজী? ‘ পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক ( তিনি আজ জীবিত নেই বলে তাঁর নাম প্রকাশ করলাম না ) শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষ কে বলেছিলেন – ” আপনাদের কোনো ধারণাই নেই বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের ওপর কী পরিমাণ সরকারী চাপ ছিল! ” তখনকার মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার, অার পূর্বতন কংগ্রেস সরকার কখনোই নেতাজী রহস্য উন্মোচনে সদিচ্ছা দেখায় নি। সম্ভবত সেই কারণেই বিচারপতি মুখোপাধ্যায় শেষরক্ষা করতে পারেন নি। তবু নেতাজী রহস্য উন্মোচনে যে কাজ বিচারপতি মুখোপাধ্যায় করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বিচারপতি মুখার্জীর সঙ্গে নেতাজী তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর শ্রী দুলাল নন্দীর ( মুখার্জীর কমিশনের একজন deponent ) সাথে জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদক , কমিশনের অন্যতম witness – শ্রী বিজয় কুমার নাগ গিয়েছিলেন জানতে উনি কী লিখেছেন রিপোর্টে। একান্ত আলাপচারিতায় বিচারপতি মুখোপাধ্যায় বলেন – ” আমি শতকরা দুশো ভাগ নিশ্চিত অযোধ্যার ফৈজাবাদের সাধুই নেতাজী। কিন্তু আমি তো আগ বাড়িয়ে সে কথা বলতে পারি না। বসু পরিবারের কেউ সামান্য ইশারা দিলে আমি সেটাকে প্রমাণ করতাম “।
— সেই স্পষ্ট বক্তা মহান জজ কে প্রণাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার —
শ্রী বিজয় কুমার নাগ, সম্পাদক, জয়শ্রী পত্রিকা ট্রাস্ট
অধ্যাপক নন্দলাল চক্রবর্তী ( প্রাক্তন অধ্যাপক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় )
শ্রী অম্লান কুসুম ঘোষ , লেখক , চিত্র পরিচালক , নির্দেশক, সুখবর পত্রিকা
অংশুমান গঙ্গোপাধ্যায় ( Angshuman Gangopadhyay )