বিক্রমের সফল ‘সফ্‌ট ল্যান্ডিং’-এ ভূমিকা যাদবপুরের, ইসরোর সহযোগী অমিতাভ, সায়ন

বিতর্কের আবহেই এল খুশির বার্তা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের সফল অবতরণের ‘ইতিহাস’ গড়ার পরে। চাঁদের মাটিতে বিক্রমের ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম ‘সফ্‌ট ল্যান্ডিং’) কর্মসূচিতে ইসরোর সহযোগীর ভূমিকায় ছিল দেশের কয়েকটি প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই তালিকার অন্যতম নাম যাদবপুর। রাজ্যের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফে অবতরণের প্রকল্পে নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অমিতাভ গুপ্ত এবং ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক সায়ন চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন আরও কয়েক জন গবেষকও।

অমিতাভ জানান, ইসরোর চন্দ্রযান প্রকল্পে সহযোগী হওয়ার জন্য ‘রেসপন্ড’ প্রকল্পের মাধ্যমে আবেদন জানানো হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে। সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়। ভিনগ্রহে কিংবা উপগ্রহে ‘সফ্‌ট ল্যান্ডিং’ হল মহাকাশ অভিযানের সব থেকে কঠিন ধাপ। ২০১৯ সালে সফল উৎক্ষেপণের পরেও নামতে গিয়েই বিপত্তি ঘটেছিল চন্দ্রযান-২ অভিযানে। এ বার যাতে পালকের মতো মসৃণ ভাবে চাঁদের মাটি ছোঁয়া যায় তার উপরেই বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। যদিও ২০১৯-এর আগেই ২০১৭-১৮ থেকে ইসরোর চন্দ্র অভিযান সংক্রান্ত ‘পাইলট প্রজেক্টে’ সহযোগী হয়েছিল যাদবপুর। যার চূড়ান্ত সাফল্য মিলল বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে।

অমিতাভ জানান, এ বার চাঁদে পাড়ি দেওয়া বিক্রমে একাধিক ‘থ্রাস্টার’ ছিল। তার সাহায্যেই পালকের মতো চাঁদের মাটিতে অবতরণ হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ভাষায় একে ‘ফেদার টাচ’ও বলা হয়। অমিতাভর ব্যাখ্যা, থ্রাস্টারগুলির মাধ্যমে জ্বালানি নিঃসরণ বাড়িয়ে-কমিয়ে নিরাপদ অবতরণ সম্ভব হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই প্রযুক্তির নাম ‘হোভারিং টেকনোলজি’। অর্থাৎ, অবতরণের আগে ল্যান্ডার হেলিকপ্টারের মতো একটি জায়গায় স্থির হয়ে প্রথমে চাঁদের কুমেরুর অবতরণস্থলটি নিরীক্ষণ করেছে। তার পর পরিস্থিতি বুঝে ‘থ্রাস্টার’-এর মাধ্যমে নিজেকে সোজা রেখে নীচে নেমে এসেছে।

অমিতাভ এবং তাঁর সহযোগী গবেষকেরা এই অবতরণের একটি পরিস্থিতি (রিয়েল টাইম সিমুলেশন) তৈরি করছিলেন। তার পরে ল্যান্ডারের একটি মডেল তৈরি করে সেই সিমুলেশন-এর মাধ্যমে নিরাপদ অবতরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এই পর্বটি হয়েছে কম্পিউটারে। অমিতাভ বলেন, ‘‘ইসরোর তরফে চাঁদে অবতরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গল গ্রহের ক্ষেত্রেও পৃথক সিমুলেশন মডেল তৈরি করা সম্ভব।’’ তাঁর কথায়, ‘‘২০১৯ সাল থেকে আমাদের কাজ শুরু হয়েছিল। ২০২২-এর জুলাই মাসে কাজ শেষ হয়। এক জন পিএইচডির গবেষক, তিন জন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র এবং কয়েক জন বিই (ইঞ্জিনিয়ারিং) ইন্টার্ন ছিলেন এই প্রকল্পে।’’ জানান, যাদবপুরের গবেষণাগারে কাজের পাশাপাশি ইসরোর সদর দফতরেও যেতে হয়েছিল তাঁদের।

ওই প্রযুক্তির ‘ইমেজিং’ সংক্রান্ত গবেষণায় অন্যতম সহযোগীর দায়িত্বে ছিলেন সায়ন । মহাকাশযানটির অবস্থান অবতরণস্থল থেকে সরে গেলেও যাতে বোঝা সম্ভব হয়, তার জন্য অবতরণস্থলের আশপাশের অঞ্চলের বহু ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। লক্ষ্য ছিল, যদি ওই মহাকাশযান সরে যায় অথবা তির্যক কোণে থাকে তা হলে ছবি দেখেই তার অবস্থান বোঝা যাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি বিক্রমকে। রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে নিরাপদেই অবতরণ করেছে সে। সায়ন বলেন, ‘‘অতীতে ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নিয়েছিল। চন্দ্রযান-৩ সংক্রান্ত সফ্‌ট ল্যান্ডিংয়ের আমাদের এই অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে একটি স্বীকৃতি।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ঘটনা উল্লেখযোগ্য বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.