প্রভু নিত্যানন্দ সাধক শ্রীজীবশরন দাস নিতাই চরনে সমাহিত হলেন

বীরচন্দ্রপুর শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ জন্মস্থান আশ্রম তথা “নিতাই বাড়ি”র স্বার্থক রূপকার শ্রীজীবশরন দাস নিত্যানন্দ লোকে লোকান্তরিত হলেন। কোলকাতায চিকিৎসা চলাকালীন গত ১৫ই আগস্ট বিকাল ৪.১৫ তাঁর মহাপ্রযান ঘটে। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। কম বেশি দীর্ঘ উনপঞ্চাশ বছর তিনি নিতাইবাড়ি আশ্রমের অধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াই করে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থানকে সারা পৃথিবীর বুকে পরিচিতি দেন এই বৈষ্ণব সাধক। তাঁর প্রয়ানে বৈষ্ণব জগতের এক অপূরনীয ক্ষতি হয়ে গেল। পরদিন সন্ধ্যায় যথাযোগ্য মর্যাদায় নিতাইবাড়িতে তাঁর পুতদেহ সমাহিত করা হয়। তাঁকে শেষ দর্শনের জন্য এবং শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে সারা বাংলার বিভিন্ন বৈষ্ণব তীর্থের প্রতিনিধিরা আশ্রম প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। শ্রীনবদ্বীপধামের সমাজ বাড়ি আশ্রম, কলকাতার শ্রীপাঠবাড়ি, শ্রীখন্ডের মধুমতী সমিতি, পুরীর ঝাঁঝপিঠা মঠ, বৃন্দাবনে গোবিন্দ কুন্ডের আশ্রম, কাটোয়া গৌরাঙ্গবাড়ি, কাটোয়া মাধাইতলা, উত্তর চব্বিশ পরগনার পলতার নিতাই গৌরাঙ্গ ভক্ত সেবাশ্রমের মত বহু তীর্থ ভূমি থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। তাঁর প্রয়ানে শোকের ছায়া সমগ্র বৈষ্ণব জগতে।
বাংলার অহিংস গণ-আন্দোলনের নেতা যদি হন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। তবে অবশ্যই সেই আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু। সেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থান অবশ্যই বীরভূমে। যে কারনেই তাঁকে বীরভূমের পূর্নশশী রূপে আখ্যায়িত করে থাকে সমগ্র বৈষ্ণব সমাজ।
বীরভূমের ময়ূরেশ্বর ব্লকের ডাবুক পঞ্চায়েতের অন্যতম গ্রাম বীরচন্দ্রপুর। যে গ্রামে আজ থেকে ৫৪৭ বছর আগে পিতা হাড়াই পন্ডিতের ঘরে ও মা পদ্মাবতীর গর্ভে আবির্ভূত হন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। ডাকনাম নিতাই
যে বাড়িতে বসবাস করতেন হাড়াই পন্ডিত সেই বাড়িটি আজও অবিকৃত। নিত্যানন্দের জন্মভূমি তথা আবির্ভাব স্থানটি, আজও সুচিহ্নিত। যা সূতিকা মন্দির বা আঁতুড় ঘর নামে খ্যাত। ঐ বাড়ি থেকে ১২ বছর বয়সে (সম্ভবতঃ) সন্ন্যাসী শঙ্করারন্য পুরীর সঙ্গে গৃহ ত্যাগ করেন নিত্যানন্দ প্রভু।উত্তরকালে বৃন্দাবনবাসী রাঘব পন্ডিত গোস্বামী নিতাই বাড়িতে এসে প্রভু নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সেই পৈতৃক বাড়িটি নিত্যানন্দ জন্মস্থান আশ্রম তথা নিতাইবাড়ি রূপে সারা পৃথিবীর বৈষ্ণব সমাজের কাছে সমাদৃত হয়ে ওঠে।
সেই নিতাই বাড়ি আশ্রমের দ্বাদশ মঠাধ্যক্ষ রূপে আজ থেকে উনপঞ্চাশ বছর আগে দায়িত্বভার গ্রহন করেন এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী শ্রীজীবশরন দাস। কলকাতা বরাহনগর শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রমের বিশিষ্ট সাধক, নামাচার্য শ্রীরামদাস বাবাজী মহাশয়ের মন্ত্রশিষ্য শ্রীজীবশরন দাস নিতাই বাড়ির দায়িত্ব নিয়ে এলেন তখন। সেইকালে আশ্রমে যাবার কোন রাস্তা বলে কিছু নেই। আশ্রম প্রাঙ্গণে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত নেই। আশ্রমে সেবা পুজোর জন্য সম্বল কেবলমাত্র ভিক্ষা। দুবেলা ভিক্ষা করে যা জুটত তাই ঠাকুরের ভোগ দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতেন সেই তরুন সন্ন্যাসী। আশ্রমে একটি মাটির মাঠকোঠা ঘর। জঙ্গল ঘেরা আশ্রমে শুধু মাত্র ঠাকুরের মন্দির ও নাটশালা ছাড়া আর কিছুই নেই। এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দীর নিরলস প্রচেষ্টায় আজ নিতাইবাড়ি আশ্রমে যে প্রভু নিত্যানন্দের মন্দির তৈরি হয়েছে তা সারা বীরভূমের সর্ববৃহৎ সুউচ্চ মন্দির। নয় চূডা বিশিষ্ট সুবিশাল উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরের আদলে এবং বাংলার মন্দির শৈলীর মিশ্রনে নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি। মন্দির গাত্রে উড়িষ্যার এবং রাজস্থানের পাথর খোদাই করা শিল্প কর্ম শোভিত হচ্ছে সারা দেবালয় জুড়ে। আজ বীরভূমের পর্যটন মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল স্থান বীরচন্দ্রপুর নিতাইবাড়ি। আশ্রমে মাঘ মাসে নয় দিন ব্যাপী বিশাল উৎসবের আয়োজন হয় নিত্যানন্দ প্রভুর জন্ম উৎসব উপলক্ষে। সেই সময় নিতাই বাড়িতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বৈষ্ণব সাধকরা এসে উপস্থিত হন।

নিতাই বাড়িতে শুধু মন্দির নির্মাণ নয়, তৈরি হয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থ সম্ভারে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।বৈষ্ণব সাধকদের ব্যবহৃত সামগ্রীর প্রদর্শনীক্ষেত্র, নিত্যানন্দ রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর মত একাধিক প্রকল্প রূপদানের প্রচেষ্টায় ছিলেন শ্রীজীবশরন দাস। আশ্রম প্রাঙ্গণে অতিথি ও পুন্যার্থীদের থাকার জন্য সুবিশাল অতিথিশালা। আশ্রম প্রাঙ্গণে জৈব চাষের মাধ্যমে সব্জি উৎপাদন, ফলের বাগান, ফুলের বাগান সকল দর্শককে আকর্ষিত করে। এমনকি সুবিশাল গোশালাও। গোবর গ্যাসের মত একাধিক প্রকল্পে সমৃদ্ধ আশ্রম প্রাঙ্গন। তাঁর উদ্যোগেই বছরে একাধিক বার করে স্বাস্থ্য শিবির, চক্ষু পরীক্ষা শিবির, নিঃশুল্ক চশমা বিতরন, গরীব আতুরজনদের শীত বস্ত্র বিতরণ, মহিলাদের বস্ত্রদানের পর্ব চলে বছরভর।
বন্যা, খরা, করোনার মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়েও খাদ্য সামগ্রী বিতরণে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গেছে সন্ন্যাসী শ্রীজীবশরন দাসজীকে।
আশ্রম থেকে শ্রীজীবশরন দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আশ্রমের ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘উত্তরন’।যা সারা দেশের বৈষ্ণব সমাজের কাছে একান্ত ভাবে সমাদৃত। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর ভাবাদর্শ প্রচারে প্রতি বছর প্রকাশিত হয় গবেষনা মূলক গ্রন্থ ‘ধীমহি’। সারা ভারতের বৈষ্ণবতীর্থ সমূহের বিবরণ তুলে ধরা থাকে এই গ্রন্থের পাতে। শ্রীপাট পর্যটন, বিগ্রহ সেবা, সমাধি সেবা সম্বন্ধিত তথ্য সম্বলিত গবেষনা মূলক গ্রন্থ এই ‘ধীমহি’। এছাড়াও প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ প্রণয়ন শ্রীজীবশরন দাসের অমর কীর্তি।
বৈষ্ণব সাহিত্যে যে রস কীর্তনের উল্লেখ রয়েছে। তার এক বিখ্যাত কীর্তন সেবক শ্রীজীবশরন দাস। তিনি বৃন্দাবন, পুরী, নবদ্বীপ, কালনা, কাটোয়া, কলকাতা, জয়পুর, সলেমাবাদ, নাথদ্বারা, বেনারসের মত একাধিক তীর্থ ক্ষেত্রে কীর্তন করে শ্রোতাদের মোহিত করেছেন।


বহু লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বহু তীর্থক্ষেত্রে তাঁর দান ছিল সর্বজনবিদিত।’নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ’, ‘মহানাম কালচারাল এন্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ এর মতো ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব ও সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন গুরুত্ত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক। তাঁর মহাপ্রয়ানে বাংলার বৈষ্ণব জগৎ এক অবিভাবককে হারালো।কোলকাতার বরাহনগর শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রমের পন্ডিত প্রবর শ্রী মাধবানন্দ দাস বাবা বলেন, “শুধু নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায় নয়, সমগ্র জাতি এক অভিভাবক কে হারালো।”
তবে শুধু বাংলা নয় বৈষ্ণব তীর্থ ভূমি বৃন্দাবন ও উডিষ্যা বিভিন্ন মঠ মন্দিরের সাধকরা আজ শোকাহত। পুরীর শ্রী ঝাঁজপিটা মঠের অধ্যক্ষ শ্রী সচ্চিদানন্দ দাস বাবা বলেন, “আমরা মর্মাহত এবং শোকাহত। উনি আমাদের কাছে বটবৃক্ষসম।”
শ্রী ধাম বৃন্দাবনের শ্রী রাধাকুন্ডের বৈষ্ণব সাধক, পন্ডিত শ্রী বৈষ্ণবপদ দাস বাবাজী বলেন, “এই ক্ষতি সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের ক্ষতি।”
বাংলা জুড়ে যে বিভিন্ন চৈতন্য পরিকর দের শ্রীপাট রয়েছে। সেই সব স্থানের বর্তমান আচার্যরা ও আজ তার মহাপ্রযানে শোকাহত ।শ্রী নামব্রহ্ম শ্রীপাট নদীযা র আলাই পুরের সেবক রাধা বিনোদ ঠাকুর গোস্বামী বলেন,”শ্রী জীব শরন দাসের প্রযানে বাংলার বৈষ্ণব জগৎ আজ দিশেহারা। “
শ্রীপাট কানাই ডাঙা মন্দিরের সেবক কৃষ্ণেন্দু গোস্বামী বলেন,” গৌরীয বৈষ্ণব জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ শ্রী পাদ শ্রীজীব শরন দাস জীর শ্রী নিতাই চরন তথা ভক্ত হৃদয় আকাশ এ বিরহ মেঘে ঢাকা পরলেন। আমরা আজ দিশেহারা ।”
শ্রীখন্ড মধুমতী সমিতির অধ্যক্ষ প্রকাশানন্দ ঠাকুর বলেন, “শ্রীখন্ডের আত্মজন, শ্রীজীব শরন দাসের লোকান্তরিত হওয়ায় আমরা বাকরুদ্ধ। প্রিয়জন, নিজজন কে হারিয়ে আমরা ব্যথিত।”

তবে শুধু বৈষ্ণব সমাজই নয়। বাংলার বিভিন্ন মত পথের সাধক দের আপনজন কে হারিয়ে তারাও আজ শোকেমুহ্যমান। কোলকাতার মহানাম অঙ্গনের সাধক বন্ধুগৌরব ব্রহ্মচারী জী,বলেন,” এই মহাপ্রয়াণে আমরা শোকস্তব্ধ। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি “

মুলুক ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অধ্যক্ষ স্বামী সঙ্ঘমিত্রানন্দ মহারাজ বলেন, “বীরভূমবাসী আজ এক মানব দরদী আপনজন কে হারালো। “

তিলক সেনগুপ্ত। বীরচন্দ্রপুর। বীরভূম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.