ধ্রুপদী বাংলার কার্যকরী বিকাশের জন্য চাই ‘ভারতীয় বঙ্গবিদ্যা সংস্থান (Indian Institute of Bengal Studies)

সম্প্রতি বাংলা ভাষা কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এটা দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ও দাবী ছিল বাঙালির, এইবার তা পূরণ করল সরকার। সমস্ত বাঙালি এই ঘোষণায়, এই মর্যাদায় আনন্দিত এবং উৎফুল্ল হয়েছে। নতুন আশায় তারা বুক বাঁধছে, বাংলাভাষার গাঙে ব্যবহার উপযোগী বান আসবে। বাঙালির উত্তরাধিকার বহন করে কীভাবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, ভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষাভাষীদের যে বোধ, সমৃদ্ধি এবং মানসচিন্তার অগ্রগতি সম্ভব, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এবার তা ভাবার সময় হয়েছে।

ভাবতে হবে বাংলাভাষাকে কীভাবে গুরুত্বের অন্তরঙ্গে এবং বহিরঙ্গে বাড়িয়ে তোলা যায়। অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে যেমন বাংলাকে জনপ্রিয় করানোর চেষ্টা থাকবে, পাশাপাশি বাংলাভাষীদের মধ্যেও বাংলাকে জনপ্রিয় করতে হবে, কারণ এখনও অনেক বাঙালি শিক্ষাবিদ মনে করেন ভাষার মাধ্যম হিসাবে বাংলাকে রেখে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা একেবারেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, এঁদের সম্পর্কে একটি কথা বলতেন, হয় তারা ভাষাটি জানেন না, অথবা বিজ্ঞান জানেন না। এটি সঠিক মুহূর্ত যে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে যথাসম্ভব বাংলাকে ব্যবহার করার সওয়ালের সময় এটা। পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতির যে অমূল্য সম্পদ ইতিউতি রয়েছে তা প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি কার্যকরী পর্যটন ব্যবস্থা বা ট্যুরিজম গড়ে তোলা যায়।

যে বিষয়গুলি ভাবা যায় তা এইরকম হতে পারে:
১. বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিবিড় চর্চার প্রয়োজনে, বহুল ব্যবহারের লক্ষ্যে, গবেষণার সুসংবদ্ধ উদ্দেশ্যে ‘Indian Institute of Bengal Studies’ নামক একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠন। এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানটির নাম এটাও হতে পারে — ‘ভারতীয় বঙ্গবিদ্যা সংস্থান’। প্রস্তাবিত সংস্থানটি প্রতিষ্ঠিত হবে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে এবং অন্যান্য ধ্রুপদীভাষার পারস্পরিক সমন্বয়ের আবহে। কলকাতার নিউটাউনে মূল কেন্দ্রটি স্থাপন করে রাজ্যের চারটি স্থান যথা দুর্গাপুর (পশ্চিম বর্ধমান জেলা), শান্তিপুর (নদীয়া জেলা), বালুরঘাট (দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা) এবং আলিপুরদুয়ার (আলিপুরদুয়ার জেলা)-এ হতে পারে চারটি উপকেন্দ্র। প্রতিটি উপকেন্দ্র নিকটস্থ জেলাগুলির ভাষাতাত্ত্বিক বিকাশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবে, উপভাষাগত শব্দ ও পরিভাষা সংগ্রহ ও সংকলন করবে, আঞ্চলিক লৌকিক উপাদান সংগৃহীত হবে, কৃষি ও গ্রামীণ শিকড় সংস্কৃতির যাবতীয় উপাদান সংগ্রহ, সংকলন এবং বিশ্লেষণ করা হবে। মূলকেন্দ্র ও চারটি উপকেন্দ্রে পাশাপাশি তৈরি হতে পারে বঙ্গসংস্কৃতির কার্যকরী মিউজিয়াম, যা গবেষক এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠবে। মিউজিয়ামের নামকরণ করা যেতে পারে সেই অঞ্চলের বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতির খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নামে।

২. বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা দানের পুরোপুরি এবং স্বনির্ভর ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। একটি ধ্রুপদী ভাষা গড়ে ওঠে বহুযুগের বহু জ্ঞাত ও অজ্ঞাত লেখকদের, কথকদের এবং ভাষাভাষী সাধারণ মানুষের সক্রিয় প্রয়াসে। তাই সেই ভাষার ক্ষমতা অসীম। তাই সেই ভাষায়-ভাবনায় অতুল্য দৃষ্টিভঙ্গী। এই সম্পদ ও ঐতিহ্যকে সঙ্গী করেই বাংলা ভাষায় যেকোনো বিষয়ের গবেষণা/ অভিসন্দর্ভ এবং গবেষণা পত্র রচনা কঠিন নয়। কিন্তু তারজন্য কিছু শিক্ষাবিদের অনমনীয় ভাব কাটাতে হবে এবং সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যথাযোগ্য ছাড়পত্র দিতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক রচনায়। বইগুলি যথেষ্ট উচ্চ মানের হওয়া দরকার। বইগুলো সুখপাঠ্যও হতে হবে। দরকার অতি উচ্চ মানের বাংলাভাষায় প্রকাশিত বিবিধ জার্নাল। অবিলম্বে তা সব বিষয়ের জন্য বিশেষত চালু করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের অন্তর্দৃষ্টি, মন্তব্য, প্রস্তাব এবং উপদেশগুলি যদি একটি গুগুল ফর্মে কয়েকটি প্রশ্নের আকারে দেওয়া হয় এবং প্রেরিত উত্তরগুলি যথাযথভাবে অ্যানালিসিস করা হয়, তবে একটি সুন্দর পথনির্দেশ এক্ষেত্রে বেরিয়ে আসতে পারে।

৩. ভাষা প্রচার ও প্রসারের বিষয়ে একটি সদর্থক ভিশন থাকা জরুরি। একটি টাইমফ্রেম করে দিতে হবে, কত মাস বা কত বছরের মধ্যে কোন লক্ষ্যে আমরা উপনীত হবো। আগামী ১০ বছরের স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রচনা করা দরকার। বাংলা ভাষা প্রচারের অগ্রগতি বিষয়ে নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইনে বৈঠক চাই, কাজে কতটা ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে এবং কেন, তার অডিট চাওয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয় স্তরে ‘Directorate of Bengali’ গঠন করলেই সবচেয়ে ভালো।

৪. যে সব ভাষা ক্লাসিকাল ল্যাঙ্গুয়েজ রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদের অনেকের যেমন বাংলার ক্ষেত্রে বিবিধ শতকের ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় নি। জায়গায় জায়গায় সাহিত্যের ইতিহাসে অধীত জ্ঞানের কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। ভাষার ইতিহাস-রূপ একটি মালার এক একটি ‘আঙটা’ বা ‘কড়া’ হচ্ছে বিভিন্ন শতাব্দীর প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি বা শিলালিপি/ধাতুলিপিগুলি। সেই মালায় কিছু ফাঁক বা ‘আঙটা’ রয়ে গেছে। সেখানে আমাদের অনেক কিছু অনুমান করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা Artificial intelligence -এর মতো আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারিগরী ব্যবহার করে সেই ফাঁকগুলি পূরণ করতে পারি কিনা ভাবতে হবে।

ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.