ছুটির রবিবার হয়ে উঠল আন্দোলনের রবিবার। কেন্দ্রে কলকাতা রইলেও, ‘বিচার চাই’ দাবিতে পথ বা মঞ্চ ভরল নানা জেলার নানা শহরে। কলকাতা দুপুর না গড়াতেই ছিল মিছিলে চঞ্চল। কোথাও দলীয় ব্যানারে, কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাম্ভীর্যে, কোথাও নির্দলীয় শাসনে সাড়া দিল মহানগর। এবং বুঝিয়ে দিল, আরজি করের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ আর আতঙ্কের যে ‘বিস্ফোরণ’ জন্ম নিয়েছিল, তা তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সময়ের পলিতে ঢাকা পড়ে যায়নি।
সবচেয়ে নজরকাড়া অবশ্যই ‘আমরা তিলোত্তমা’র প্রতিবাদ। আরজি কর-কাণ্ডে বিচার চেয়ে দুপুর ৩টের কিছু পরে কলেজ স্কোয়্যার থেকে শুরু হয় মিছিল। তার পর বউবাজার হয়ে বিকেলে মিছিল পৌঁছয় ধর্মতলায়। মিছিলে বিভিন্ন বয়স, বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গেই পা মিলিয়েছিলেন টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একাংশ। মিছিলে দেখা যায় অপর্ণা সেন, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, উষসী চক্রবর্তী, অপরাজিতা আঢ্য, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, সোহিনী সরকার প্রমুখকে। মিছিলে ছোটদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। বড়দের পাশাপাশি মাথায় ‘তিলোত্তমা’ লেখা বেগনি ফেট্টি বেঁধে স্লোগান দিতে দেখা যায় খুদে প্রতিবাদীদেরও।
রবিবার গোলপার্ক থেকে নন্দন পর্যন্ত প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রাক্তনীরা। ছিলেন তাঁদের পরিবারের সদস্যেরাও। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই কালো পোশাক পরেছিলেন। মিছিল মৌনী হলেও প্রতিবাদীদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে বিচার চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ছিল। এ ছাড়াও একাধিক সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলান।
‘আমরা তিলোত্তমা’র মিছিল
কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা— ‘আমরা তিলোত্তমা’র প্রতিবাদ মিছিলে সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বিচার চেয়ে স্লোগান দিতে দেখা গেল টলিউডে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। মিছিল থেকে স্লোগান উঠল, “দফা এক, দাবি এক, সব দোষী শাস্তি পাক।” ম্যাটাডর থেকে জনস্রোতকে লক্ষ্য করে জনৈক তরুণী মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে বলেন, “প্রীতিলতার এই মাটিতে ধর্ষকদের ঠাঁই নাই।” সাধারণের ভিড়ে মিশে স্লোগান দিতে দেখা যায় স্বস্তিকা, সোহিনী, বিদীপ্তাদেরও। টলি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রত্যেকেই জানান, বিচার না পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলনকে টলানো যাবে না। পরে মিছিল শেষের পর একগুচ্ছ দাবি তুলে ধরেন উদ্যোক্তারা। সেখানে আরজি করের ঘটনায় দ্রুত বিচারের পাশাপাশি ওই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে অপসারণ করার দাবিও জানানো হয়েছে।
বিচারের দাবিতে ধর্না
ধর্মতলায় মিছিল শেষ হওয়ার হওয়ার পরে বেশ কয়েকটি কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। মিছিলের উদ্যোক্তারা ভোর ৪টে পর্যন্ত রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান চলার কথা জানান। মিছিলের ভিড় খানিক পাতলা হয়ে গেলেও অনেকেই অবস্থানে বসে পড়েন। অনেকেই সেখানে বক্তব্য রাখেন। ‘কারার ওই লৌহকপাট’-এ গলা মেলান সকলে। ধর্না অবস্থানে দেখা যায় ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা রিমঝিম সিংহও।
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনীর মিছিল
রবিবার আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দাবি করে মৌনী মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রাক্তনীরা। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা দুপুরে গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। যাত্রা শুরু হয় শঙ্খধ্বনি দিয়ে। গড়িয়াহাট, রাসবিহারী, ভবানীপুর ছুঁয়ে মিছিলের গন্তব্য ছিল নন্দন। মিছিলে রামকৃষ্ণ এবং সারদা দেবীর বানী সম্বলিত একাধিক পোস্টার দেখা যায়। কিছু পোস্টারে লেখা ছিল ‘সবুর করো মা গো তোমার সব সন্তান অন্ধ নয়, মৌনী আছি তার মানে আমরা সবাই অন্ধ নই’, ‘আমরা মৌনী নই, বাক্রুদ্ধ’, ‘কন্যা রে তোর চিতার শপথ, ওই আগুনেই পুড়বে শোষক’। রবিবারের এই কর্মসূচির আয়োজকদের তরফে উৎসব রায় বলেন, ‘‘এই পদযাত্রা কোনও সংগঠনের নয়, অন্তরের দাবিতে, বিবেকের তাড়নায় আমরা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনীরা প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। আরজি করের ঘটনায় আমরা কেউ মৌনী নই, আমরা বাক্রুদ্ধ। আমরা বলতে চাই, নৃশংস এই ঘটনার নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা মুখগুলি প্রকাশ্যে আসুক। অপরাধীরা সাজা পাক।”
মিছিল বিভিন্ন স্কুলের প্রাক্তনীদের
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রবিবার বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে শ্যামবাজার পাঁচ মোড় পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন দি পার্ক ইনস্টিটিউশনের প্রাক্তন পড়ুয়ারা। ওই মিছিলে প্রাক্তন পড়ুয়াদের পাশাপাশি পা মেলান শিক্ষকদের একাংশও। একই রকম ভাবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত মিছিল করেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রাক্তন পড়়ুয়ারা। দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন স্কুলের প্রাক্তন পড়ুয়ারাও আরজি কর-কাণ্ডে দ্রুত বিচার চেয়ে মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। রবিবার বিকেলে ল্যান্সডাউনে শুরু হয় এই মিছিল। তার পর দেশপ্রিয় পার্ক, রাসবিহারী মোড় হয়ে মিছিল শেষ হয় হাজরা মোড়ে।
অন্যান্য মিছিল
আরজি কর-কাণ্ডে দ্রুত বিচার চেয়ে রবিবার বিকেলে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই দফতর পর্যন্ত মিছিল করেন চিকিৎসকদের একাংশ। ওই একই সময়ে যাদবপুর এইটবি বাসস্ট্যান্ড থেকে গোলপার্ক পর্যন্ত মিছিল করেন ‘দক্ষিণ কলকাতার সম্মিলিত স্কুল প্রাক্তনী’রা। ‘ভয়েস ফর টিচার্স’ নামে একটি সংগঠন দুপুর সাড়ে ৩টেয় শিয়ালদহ থেকে কলেজ স্কোয়্যার পর্যন্ত একটি মিছিল করে। তা ছাড়়াও শহর এবং শহরতলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকে একাধিক ছোটবড় মিছিল হয় রবিবার। আরজি কর-কাণ্ডে বিচার চেয়ে এসপ্ল্যানেড মেট্রোর ২ নম্বর গেটের সামনে অবস্থানে বসেন ‘বঙ্গীয় পুরুষ মোর্চা’ নামের একটি সংগঠনের কয়েক জন সদস্য। আরজি কর-কাণ্ডের বিচার চাওয়ার পাশাপাশি অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীর লিঙ্গ পরিচয়কে কেন মুখ্য করে দেখা হবে, সেই প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।