৭০ মিনিট ন’জনে লড়াই সাহসী ইস্টবেঙ্গলের, প্রথম পয়েন্ট আইএসএলে, সুযোগ নষ্ট মহমেডানের

২৯ মিনিটে জোড়া লাল কার্ড। শনিবার যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল বনাম মহমেডানের মিনি ডার্বিতে যে এই অবস্থা হবে তা কল্পনাও করা যায়নি। রেফারি হরিশ কুন্ডুর ‘সৌজন্যে’ সেটাই হল। অতিরিক্ত সময় ধরে ৭০ মিনিট ন’জনে খেলেও এক পয়েন্ট আদায় করল ইস্টবেঙ্গল। যে ম্যাচে তাদের হার ছিল কার্যত নিশ্চিত, সাহসী ফুটবল খেলে সেখান থেকেই তারা এক পয়েন্ট সংগ্রহ করল। এ বারের আইএসএলে এটাই ইস্টবেঙ্গলের প্রথম পয়েন্ট। ম্যাচটি তারা ১১ জনে খেললে তিন পয়েন্ট আসতেই পারত। তবে এই ড্র-ও জয়ের থেকে কম নয়। আইএসএলে একটানা হেরে দলের মনোবল যে ভাবে তলানিতে নেমে গিয়েছিল, সেখান থেকে এই পারফরম্যান্স গোটা দলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে আঘাত করার জন্য ২৯ মিনিটে রেফারি লাল কার্ড দেখান নন্দকুমার সেকারকে। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করায় পরের মিনিটেই দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখেন নাওরেম মহেশ। জোড়া লাল কার্ডে মাথায় হাত পড়েছিল লাল-হলুদ কোচ অস্কার ব্রুজ়োর। তবে তাঁর ছেলেরা মাঠে দলের মান রাখলেন। কাজটা সহজ ছিল না। ৬০ মিনিট দশ জনে খেলতে হতই। দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা অকারণে অনেকটা সময় নষ্ট করলেন বলে আরও দশ মিনিট খেলতে হল।

পেনাল্টি না দেওয়া

শুরু থেকে আগ্রাসী খেলছিল ইস্টবেঙ্গল। বেশ কয়েক বার মহমেডানের গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল তারা। ২১ মিনিটের মাথায় ঘটনাটি ঘটে। মাদিহ তালাল পাস দিয়েছিলেন দিমিত্রি দিয়ামানতাকোসকে। গ্রিক স্ট্রাইকার বল নিয়ে বক্সে ঢোকার মুহূর্তে তাঁকে ফেলে দেন মহমেডানের বিকাশ সিংহ। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা পেনাল্টির আবেদন করলেও কর্ণপাত করেননি রেফারি। রিপ্লে-তে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, বক্সের ভেতরেই দিয়ামানতাকোসকে আঘাত করেছিলেন বিকাশ। রেফারি পেনাল্টি দিলেও কিছু বলার ছিল না। কিন্তু হরিশ কোনও কথাই শোনেননি।

জোড়া লাল কার্ড

ম্যাচের সবচেয়ে ঘটনাবহুল মুহূর্তটি আসে এর কিছু ক্ষণ পরেই। শুরু থেকেই দুই দলের আক্রমণ-নির্ভর ফুটবল যে ভাবে পরিচালনা করছিলেন তাতে মনেই হচ্ছিল রেফারির ম্যাচের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। ২৯ মিনিটে তিনি প্রথম লাল কার্ডটি দেখান নন্দকুমার সেকারকে। বল কাড়াকাড়ির মুহূর্তে ডান হাত দিয়ে নন্দকুমার আঘাত করেছিলেন অমরজিৎ সিংহ কিয়ামকে। লাইন্সম্যানের সঙ্গে অনেক ক্ষণ পরামর্শ করার পর হরিশ সরাসরি লাল কার্ড দেখান নন্দকুমারকে।

দ্বিতীয় লাল কার্ড হয় এক মিনিট পরেই। আগেই একটি ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখে বসেছিলেন মহেশ। নন্দকুমারকে লাল কার্ড দেখানোর পরে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখান হরিশ। আইএসএলের ইতিহাসে আগে কোনও দিন প্রথমার্ধে কোনও দল জোড়া লাল কার্ড দেখেনি। তা-ও আবার এটি ডার্বির মতো ম্যাচ। সাধারণত এ ধরনের ম্যাচে একটি লাল কার্ড হওয়ার পর কোনও গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে রেফারি প্রথমে সংশ্লিষ্ট ফুটবলারকে সতর্ক করে দেন। কারণ ন’জন হয়ে গেলে যে কোনও দলই বিপদে পড়বে। হরিশ কোনও রকম সতর্কবাণী শোনাননি। মহেশকেও দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বার করে দেন। বেরনোর সময়ে যে ভাবে বলে লাথি মেরে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মহেশ, তাতে তাঁর নির্বাসন আরও বাড়তে পারে।

মহমেডানের অগুন্তি সুযোগ নষ্ট

কোনও দল যদি ৩০ মিনিটেই দেখে বিপক্ষে ন’জন হয়ে গিয়েছে, তারা বাকি ম্যাচে যে দাপট দেখাবে সেটাই স্বাভাবিক। শনিবার যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গলকে ঠিক সেই অবস্থাতেই পেয়েছিল মহমেডান। তবে যে দাপট তাদের থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা দেখাতে পারেনি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় মহমেডানের ফুটবলারদের পায়েই বলের দখল ছিল বেশি। ইস্টবেঙ্গলের সব ফুটবলারই রক্ষণ সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন। মাঝেমাঝে আক্রমণে উঠলেও মহমেডানের ফুটবলারেরা দ্রুত ঘিরে ফেলায় তা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে মহমেডানের ফুটবলারেরা যে ভাবে একের পর এক সুযোগ নষ্ট করে গেলেন তা চোখে লাগতে বাধ্য। বিরক্ত হয়ে প্রথমার্ধে আলেক্সিস গোমেজ়কে তুলেই নেন কোচ আন্দ্রেই চের্নিশভ। পরিবর্ত হিসাবে নামা সিজার মানজোকিও দাগ কাটতে পারেননি। ফুটবলারদের মান এবং মানসিকতা নিয়ে এ বার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে মহমেডানকে।

ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্ডারদের লড়াই

চলতি মরসুমে বার বার ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ সমালোচিত হয়েছে। ফিটনেসের অভাব, বোঝাপড়ার অভাব বার বার প্রকট হয়েছে। তবে আসল দিনে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা দেখিয়ে দিলেন, দরকার নিজেদের নিংড়ে দিয়ে ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত তাঁরা লড়াই করতে পারেন। ম্যাচের আগে পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের অনুশীলন দেখে মনে হয়েছিল রক্ষণের মাঝে আনোয়ার আলির সঙ্গে জিকসন সিংহ খেলবেন। তবে অনুমান ভুল প্রমাণ করে আনোয়ারের পাশে হিজাজি মাহেরকে রেখেছিলেন ব্রুজ়ো। দুই প্রান্তে মহম্মদ রাকিপ এবং লালচুংনুঙ্গা। এই লালচুংনুঙ্গার খেলায় কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিরক্ত ছিলেন সমর্থকেরা। এ দিন আগাগোড়া পরিণত মানসিকতা নিয়ে খেলেছেন মিজ়ো ডিফেন্ডার। কোনও খারাপ ভুল করেননি। কোথাও বিপক্ষকে জায়গা করে দেননি। হিজাজি এবং আনোয়ারেরও প্রশংসা প্রাপ্য। আসল ম্যাচে তারা সেরা খেলাটা খেললেন। গোল না খাওয়ার মরণপণ মানসিকতাই ইস্টবেঙ্গলকে একটা পয়েন্ট এনে দিল।

সময় নষ্টে হতে পারত বিপদ

১১ জনের বিরুদ্ধে ন’জনের খেলা সহজ কাজ নয়। দমের ঘাটতি হতে বাধ্য। প্রথমার্ধের ২০ মিনিট রুখে দিলেও দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি থেকে ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়দের মধ্যে দমের ঘাটতি দেখা যেতে থাকে। বিশেষ করে মাদিহ তালাল এবং দিয়ামানতাকোস বেশ মন্থর হয়ে পড়েছিলেন। তাই দম নিতে বার বারই খেলা মন্থর করে দিল ইস্টবেঙ্গল। হালকা চোট পেলেও মাঠে অনেক ক্ষণ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। চতুর্থ রেফারি ১০ মিনিট অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। ৬০ মিনিট মহমেডানকে রুখে দেওয়ার পর আরও ১০ মিনিট খেলা সহজ নয়। ইস্টবেঙ্গল গোল খায়নি বটে। তবে শেষ মুহূর্তে মনঃসংযোগ নড়ে গিয়ে গোল খেলে এই সময় নষ্টের দিকে আঙুল উঠতেই পারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.