বাড়ছে আমদানি ব্যয়, করতে হচ্ছে লোডশেডিং, বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অশনি সংকেত

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গেল সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছে যে, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিদেশে থেকে পণ্য আমদানি বা বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশীয় বা নিজস্ব মুদ্রা তথা ভারতীয় রুপি ব্যবহার করতে পারবে৷

মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল এড়িয়ে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তি সহজ করতে এ পথে এগোচ্ছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)৷ আপাতত রাশিয়ার এতে কোনো আপত্তি নেই৷ আর অতীতে ভারতীয় রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তির অভিজ্ঞতা ভারতের আছে৷ 

তবে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত একদম হঠাৎ করেই আসেনি৷ কিছুদিন ধরে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্র্রীলঙ্কা, মিয়ানমার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের মুদ্রায় নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয়টি নিয়ে কথা চালাচালি করছিল৷ মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই কয়েকটি দেশ নিজস্ব মুদ্রায় বা তৃতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ আর এই সক্রিয়তা আরেকটু বেড়েছে যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ায়৷

বাংলাদেশেও এ নিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা হয়েছে৷ আর তা মূলত রাশিয়ার সাথে রুবলে বাণিজ্য সম্পন্ন করার সম্ভাব্যতা নিয়ে৷ তবে এ নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি আর হয়নি৷ তাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে খুব সামান্য পরিমাণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি খুব কঠিন কাজ৷ আর তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করলেও তা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল হাতিয়ার হলো আমদানি ব্যয়ে রাশ টানা৷ ইতিমধ্যে সেরকম কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে যেন তুলনামূলক অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসদ্রব্য আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা যায়৷ তারপরও গত অর্থবছরের ১১ মাসে আমদানি ব্যয় সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরেরে একই সময়ের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি৷ আবার জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে চার হাজার কোটি ডলারের নীচে যা দিয়ে সাড়ে চার মাসের কম সময়ের পণ্য ও সেবাখাতের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব৷

এদিকে প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেলেও যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই৷ রাশিয়া যত দ্রুত ইউক্রেনকে নতজানু করতে পারবে বলে ভেবেছিল, তা হয়নি৷ আবার আর্থিক-সামরিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে যতটা কাবু করে সমঝোতার টেবিলে বসানো যাবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব আত্মবিশ্বাসী ছিল, বাস্তবে সেটাও ঘটেনি৷ মাঝখান থেকে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা ক্রমেই বাড়ছে, যার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটেছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যে আহবান জানিয়েছেন, তাতে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেছেন৷ তিনি যথার্থই ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে৷ উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মাসওয়ারী মূল্যস্ফীতির হার এপ্রিল মাসে যেখানে ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, সেখানে তা মে মাসে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ৷ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির একাংশকে বলা হয় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি৷ যেহেতু বিশ্ব বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ও ভোগপণ্য কম-বেশি আমদানি করতে হয়, সেহেতু বাইরে দাম বেড়ে গেলে তা দেশের বাজারেও চড়া দরে বিক্রি করতে হয়৷ এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় ও উৎপাদন ব্যাহত হয়৷ সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছেন যে, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গিয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে আর তাতে করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে৷

বস্তুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেহেতু এখন পরস্পরের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে কম-বেশি নিবিড়ভাবে যুক্ত, সেহেতু বৈশ্বিক অস্থিরতা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় সংক্রমিত হচ্ছে৷ এর ফলে অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি-ঘাটতিগুলোও এখন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে, যা আগে বিভিন্নভাবে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল৷ বাংলাদেশও এই বাস্তবতার বাইরে নয়৷ দেশের ভেতরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি তার একটি বড় দৃষ্টান্ত৷ মূলত ২০১৫ সালে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি নির্ভরতার দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ, অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে অনেকটাই অগ্রাহ্য করে৷ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয় আমদানিনির্ভর এলএনজির ওপর৷ এর ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিলেও সরকারের কাছে তা তেমন গুরুত্ব পায়নি৷ গতবছর ডিসেম্বর মাসে ইন্সটিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার সাতটি উদীয়মান দেশ অবাস্তবসম্মত আমদানিনির্ভর এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে৷ এই দেশগুলো হলো: বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান৷

পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ এখন লোডশেডিংয়ের দিকে ফিরে গেছে, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এসব পদক্ষেপ বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমালেও কতটা সুফল বয়ে আনবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ৷ তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ-সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী আমদানি নির্ভরতার জন্য বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে সংকট দেখা দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি এ-ও জানিয়েছেন যে, সেপ্টেম্বর নাগাদ লোডশেডিং কমে আসবে৷ বাস্তবতা হলো, একদিকে আমদানি-নির্ভরতা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের অপ্রতুলতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যথেষ্ট বাড়ার পরও দেশের বিদ্যুৎ উপাদন ও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে শিল্প উৎপাদনসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে৷ ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও এগুলোর জন্য নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, যা ভর্তুকি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে৷ এগুলো সবই সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার উদাহরণ৷

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে পড়ার ঘটনাও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কিছু বিপদের আভাস দিচ্ছে৷ যদিও নীতি-নির্ধারকরা দুই দেশের অর্থনীতিকে তুলনা করতে অনিচ্ছুক, তবুও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট যে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ঘাটতি একটা সময়ে এসে যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করে দিতে তো পারেই, স্থবিরও করে দিতে পারে৷

এটা ঠিক যে, শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে অতখানি ঝুঁকির পর্যায়ে যায়নি৷ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-র তুলনায় বৈদেশিক ঋণের হার এখন মাত্র ২৬ শতাংশ যেখানে এটি ৫০ শতাংশের বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়৷ তবে আগামী দিনগুলোয় বিভিন্ন বড় বা মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ তাতে করে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে উপনীত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না৷ এর সঙ্গে উচ্চহারে আমদানি ব্যয় মেটানোর চাপ যুক্ত হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অল্প সময়ের মধ্যেই নীচের দিকে নামিয়ে আনতে পারে বলে আশঙ্কা আছে৷ তাতে করে টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরো বেড়ে যাবে৷ গত তিন-চার মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত দরপতন তো এটাই আভাস দেয়৷

এভাবে অর্থনীতির জন্য কিছু অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে না৷ নীতি-নির্ধারকরা এই সংকেতগুলো কিভাবে নেবেন ও বিশ্লেষণ করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতির আগামী দিনের গতি-প্রকৃতি৷ সেই সঙ্গে এ পযন্ত অর্জিত বিভিন্ন সাফল্যও কতটা টেকসই হয়েছে, সেটাও কিছুটা যাচাই হবে বৈকি৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.