ওয়াকিল হাসান। তাঁর নেতৃত্বে থাকা ১২ জনের দলই উত্তরকাশীতে ইঁদুরের মতো গর্ত করে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করেছে। মঙ্গলবার রাতে উদ্ধারকাজ শেষে সেই ‘দলপতি’ই আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, কাজটা ভীষণ ‘চ্যালেঞ্জিং’ ছিল। কলকাতা থেকে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরের উত্তরকাশীতে থাকা ওয়াকিলের কণ্ঠস্বরে তখন স্পষ্ট যুদ্ধ জয়ের স্বস্তি। প্রায় এক শ্বাসেই জানালেন, মানুষ বাঁচানোর কাজ তাঁরা এই প্রথম করলেন। পাশাপাশি, দেশের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছেন বলে যে ‘গর্ব’ অনুভব করছেন ওয়াকিলেরা, সে কথাও বলতে ভুললেন না।
ওয়াকিলকে যখন ফোনে ধরা গেল, তখন সবেমাত্র ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। গোটা দেশের শুভেচ্ছাবার্তা আছড়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও আবেগঘন বার্তা পোস্ট করেছেন এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডলে। সেই আবহেই ওয়াকিল বললেন, ‘‘ছোট জায়গায় বসে কাজ করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। ওর মধ্যেই বসে কেটে কেটে এগিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে পাথর চলে এলে সেটা কাটা, পাইপ সরানো, মাটি সরানো.. সেই মাটি বাইরে বার করা। শেষ পর্যায়ের কাজটা খুব, খুবই কঠিন ছিল।’’ তার পরেই স্বগতোক্তির মতো ভেসে এল, ‘‘সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। ভাল ভাবেই সব শেষ হল।’’
দিল্লির বাসিন্দা ওয়াকিল। রাজধানী শহরেই ‘ম্যানুয়াল জ্যাক পুশিং’-এর কাজ করেন। মাটির তলায় জলের লাইন, কেবল লাইন বসানোর কাজ। ঠিকাদারি সংস্থায়। ওয়াকিলের দলের কেউ ১০ বছর ধরে এই কাজ করছেন। কেউ বা বছর ২০। কিন্তু এমন প্রাণ বাঁচানোর কাজ কখনও করেননি। এ বারই প্রথম ডাক এল। ওয়াকিল বলছিলেন, ‘‘৪১ জনের জীবন ওখানে আটকে আছে ভেবে আমাদের মধ্যে এমন একটা জেদ চেপে গিয়েছিল যে, কোনও না কোনও ভাবে ওঁদের বাঁচিয়ে আনার সংকল্প নিয়েছিলাম প্রত্যেকে। টিমের মধ্যে কারও এই ধরনের প্রাণ বাঁচানোর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। এত দিনের মধ্যে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং কাজ। দেশের জন্য কিছু করার একটা সুযোগ পেয়েছি, এটা ভেবেই করলাম। যুদ্ধটা জিতলামও।’’
যে পদ্ধতিতে কাজ করেছেন ওয়াকিলেরা, তাকে বলে ‘ব়্যাট হোল মাইনিং’। অর্থাৎ, ইঁদুরের মতো গর্ত করে এগিয়ে যাওয়া। ওয়াকিলের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি দল ওই কাজটি করে। ‘ব়্যাট হোল মাইনিং’ পদ্ধতি খনি থেকে কাঁচামাল উত্তোলনের জন্য প্রয়োগ করা হয়। বিশেষত কয়লা খনিতে এই প্রক্রিয়া খুবই প্রচলিত। এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খনিতে নামেন। তাঁরা অল্প জায়গা নিয়ে সরু গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে এগিয়ে চলেন। ঠিক যেমন করে গর্ত খোঁড়ে ইঁদুর। প্রয়োজনীয় কয়লা তুলে আবার ওই একই পদ্ধতিতে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। আমেরিকার যন্ত্র বিকল হওয়ার পরে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে শ্রমিকদের বার করতে মনুষ্য-নির্ভর এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়েছিল। কিন্তু এ কাজে তেমন পারিশ্রমিক নেই। যদিও ওয়াকিল আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘সব কাজ পয়সার জন্য হয় না। এই কাজ মানুষের জন্য। এখানে যেমন মানুষের জীবন জড়িয়ে ছিল, তেমনই জড়িয়ে ছিল দেশবাসীর আশা। সেই আশা পূরণ করা সহজ ছিল না। কিন্তু আমরাও আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করব। পেরেছি। সকলের আশা পূরণ করতে পেরে গর্ব হচ্ছে। দেশকে, দেশবাসীকে রক্ষা করতে সীমান্তে সেনা লড়াই করে। আজ আমাদের মধ্যে সেই অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরাও দেশের জন্য কিছু করলাম।’’
টানা প্রায় ২৮ ঘণ্টা কাজ করেছেন ওয়াকিলেরা। কিন্তু গোটাটাই পরিকল্পনা করে। ওয়াকিল বলছিলেন, ‘’১২ জনের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সময় অনুযায়ী পাঠানো হয়েছে কাজে। কাজের গতি যাতে না কমে, সেই মতো পরিকল্পনা করে এগিয়েছি। যাতে কাজ চলতে থাকে। আমাদের ক্লান্তির জন্য যাতে কাজের গতি কমে না যায়, সে কথা ভেবেই এটা করেছিলাম।’’ কখনও মনে হয়নি যুদ্ধটা হেরে যেতে পারেন? ফোনের ওপারে ওয়াকিলের কণ্ঠস্বর বেশ দৃঢ় শোনাল। বললেন, ‘‘কখনই ভাবিনি যে, এই কাজটা করতে পারব না। বা এই কাজে আমরা ব্যর্থ হব। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এই কাজটা যে কোনও ভাবে করতে হবে। এবং জিততে হবে। টিমের সকলকে বলেছিলাম, এই কাজ করতে না পারার কোনও কারণ নেই। এক বারও ভাবিনি যে, করতে পারব না। কেউ আট ঘণ্টা কাজ করেছে টানা। কেউ বা ১০ ঘণ্টা। আমাদের আগের ওই সব অভিজ্ঞতা যে এ ভাবে ৪১ জনের প্রাণ বাঁচাবে, আগে ভাবিনি।’’
ওয়াকিলের দলের ১২ জন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এগিয়েছিলে সুড়ঙ্গের ভিতরে। সেখানে পৌঁছে এক জন দেওয়াল খুঁড়তে থাকেন। অন্য জন সেই ধ্বংসস্তূপ সংগ্রহ করেন এবং তৃতীয় জন তা চাকা লাগানো গাড়িতে তুলে দেন। সেই গাড়ি ধ্বংসস্তূপ সুড়ঙ্গের বাইরে নিয়ে যায়। শেয পর্যন্ত এই পদ্ধতিতেই এসেছে সাফল্য।
গত ১২ নভেম্বর ভোরে উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ধস নামে। ভিতরে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। এত দিন ধরে তাঁদের বার করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। খোঁড়ার সময়ে গত শুক্রবার বাধা আসে। ধ্বংসস্তূপের ভিতরের লোহার কাঠামোয় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায় আমেরিকায় তৈরি খননযন্ত্র। উদ্ধারকাজ থমকে যায়। উদ্ধার করার আগে পর্যন্ত সুড়ঙ্গের শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের তরফে অনবরত যোগাযোগ রাখা হয়েছিল। পাইপের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে কথা চলছিল। পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল খাবার, জল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। দেশ-বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল উন্নতমানের যন্ত্র। এসেছিলেন তাবড় তাবড় প্রযুক্তিবিদেরা। এই যন্ত্রের যুগেও শেষ পর্যন্ত হাতই হল ভরসা। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ইঁদুরের মতো খননকাজ চালিয়ে এল সাফল্য। ১৭ দিন পর মঙ্গলবার উদ্ধার করে আনা হল ৪১ জন শ্রমিককে।
মঙ্গলবার দুপুরে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে যান উদ্ধারকারী দলের সদস্যেরা। যে পাইপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসেন শ্রমিকেরা, তা উপযুক্ত জায়গায় রাখা হয়েছিল। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা শ্রমিকদের বোঝান, কী ভাবে ওই পাইপ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে তাঁদের। এই পাইপটি আড়াই ফুট চওড়া। পাইপের যে সব জায়গায় ঝালাই হয়েছে, সেগুলি বেশ ধারালো। সেখান দিয়ে বেরোনোর সময় আঘাত লাগতে পারে শ্রমিকদের। এ সব ঝুঁকির কথাই বুঝিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, সুড়ঙ্গ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেরোবেন শ্রমিকেরা। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ দিন সুড়ঙ্গে আটক থাকার কারণে তাঁরা শারীরিক ভাবে আর সক্ষম নন। সে কারণে চাকা লাগানো ট্রলির মাধ্যমে পাইপ দিয়ে তাঁদের বার করে আনা হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ভিকে সিংহ। ৭টা ৪৯ মিনিট নাগাদ সুড়ঙ্গ থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসেন ঝাড়খণ্ডের বিজয় হোরো। তার পরে একে একে বাকিরা। রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে শেষ হল ‘অপারেশন জিন্দেগি’। উদ্ধারের পরে আগে থেকে তৈরি রাখা গ্রিন করিডর দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরকাশীর চিনিয়ালিসৌর হাসপাতালে।
আর এই গোটা বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন দিল্লির ওয়াকিল এবং তাঁর দ্বাদশী বাহিনী।