ভিটে ছেড়ে চলে আসতে হবে কখনও ভাবিনি শৈশবে: দীনেন্দ্র গোস্বামী

‘কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কেন, কোন পরিস্থিতিতে চলে আসতে বাধ্য হলেন পূর্ববঙ্গের একটা বড় সংখ্যক হিন্দু? অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে *অশোক সেনগুপ্ত*-কে তা জানালেন মিৎসুবিসি সংস্থার প্রাক্তন আধিকারিক, ৯১ বছরের *দীনেন্দ্র গোস্বামী*। তাঁর কথায়, “তৈরি হোক ‘ইস্টবেঙ্গল ফাইলস’।“

আমাদের ভারত, ২৭ মার্চ: “১০০ বছর হল আমার বাবা ডিসটিঙ্কশন নিয়ে বিএ পাশ করেছিলেন। ময়মনসিংহে যথার্থই ছিল আমাদের সাত পুরুষের ভিটে। সেটা ছেড়ে চলে আসতে হবে, কখনও ভাবিনি শৈশবে।“

‘ময়মনসিংহ প্রাক্তনী’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দীনেন্দ্র গোস্বামীর কাছে শুনছিলাম তাঁর ছেলেবেলার গল্প। কেন তাঁরা চলে এলেন এই বাংলায়? “বাবা কাজ করতেন অবিভক্ত বাংলার জজ কোর্টে, থাকতেন ময়মনসিংহ শহরে। পাঁচ ভাই, তিন বোনের মধ্যে আমি ছিলাম বড়। প্রায় সবই বর্ধিষ্ণু হিন্দুদের বাড়ির পুজো। ঠাকুর্দা ছিলেন ময়মনসিংহের আইনজীবী। ১৯২২ সালে বাবা দ্বীজেন্দ্র গোস্বামী বিএ পাশ করার পরেই তিনি তাঁকে ওখানকার আদালতে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। শহরে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর ছিল আমাদের বাড়ি। আর প্রায় ২৫ মাইল দূরে চাষের জমি-সহ ছিল গ্রামের বাড়ি। কখনও সাম্প্রদায়িক হানাহানির অভিজ্ঞতা হয়নি।

“চারের দশকের মাঝপর্ব থেকে অবস্থা বদলাতে থাকে। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট দিনে রাতে মুস্লিমরা নানারকম ধর্মীয় ধ্বণি দিয়ে মিছিল করল। হুুমকি দিল হিন্দুরা নিজেদের দেশে চলে যাক। বাবা আগেই আঁচ পেয়েছিলেন ওই দিন অশান্তি হতে পারে। আমাদের উনি কাঁচরাপাড়ায় কাকার কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলেন। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা ট্রেনে, কিছুটা পদ্মায় স্টিমারে। মা, দুই পিসি, ওঁদের ছেলেমেয়েরা—সব মিলিয়ে প্রায় ১৬-১৭ জন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে সপ্তাহ দুই বাদে ফের ফিরে যাই আমরা।


(ছবি- দীনেন্দ্র গোস্বামী)

“অনেকের আশঙ্কা সত্যি করে ’৪৭-এ দেশভাগ হল। এর ঠিক পরে সরকারি কর্মীদের ভবিষ্যতের কর্মস্থল বেছে নেওয়ার ‘অপশন’ দেওয়া হল। হিন্দুদের অনেকেই ‘অপশন’ দিলেন ভারতে চলে আসার। বাবা রাজি হলেন না। অনেকে বোঝালেন। তিনি স্পষ্টই বললেন, ‘ময়মনসিংহই তো আমার দেশ। আমি যাব না’। উনি অপশন-এর আবেদনপত্রে সই করলেন না। অন্নদাশঙ্কর রায় সে সময় ময়মনসিংহের জেলা জজ, বাবার ওপরওয়ালা। উনি একদিন বাবাকে নিজের ঘরে ডেকে বোঝালেন। তাতেও বাবা ‘দেশ’ ছাড়তে রাজি নন। হঠাৎ, কঠোর হয়ে বললেন, এই ‘অপশন’-এর ফর্ম। আমি বলছি, আপনি সই করুন। এটা আমার নির্দেশ।

“অন্নদাশঙ্কর রায় সেই নির্দেশ না দিলে আমাদের জীবনের গতিপথ কোন খাতে বইত, কে জানে? দেশ ভাগ হওয়ার মাস চার বাদে, ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে বাবার সঙ্গে আমরা চলে এলাম এপার বাংলায়। তখন আমি ক্লাশ টেনের পরীক্ষা দিয়েছি। বাবা যোগ দিলেন আলিপুর আদালতে। আমার স্মৃতির মোটামুটি তিনটি অধ্যায়। একটি ১৯৪৭ পর্যন্ত, পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে। দ্বিতীয়টি ১৯৫০ থেকে ’৫৭, এপার বাংলার বিজয়গড়ে। এর পর আমি বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে চলে আসি। অন্নদাশঙ্কর রায় থাকতেন কাছেই। ছয়ের দশকের শেষপর্বে ওনার বাড়িতে গেলাম। বাবার চেয়ে বয়সে দু’বছরের ছোট ছিলেন উনি। আমি বাবার পরিচয় দিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়কে প্রণাম করে বললাম, বাবাকে এপার বাংলায় চলে আসার নির্দেশ দিয়ে যে উপকার আপনি করেছিলেন, তা ভুলব না। উনি কেবল মৃদু হাসলেন।

“কত কথা মনে পড়ে। বাঘমারা রোডে প্রায় দু’বিঘা জমির ওপর ঠাকুর্দার বড় বাড়ি। টিনের চাল, পেট অবধি দেওয়াল ইঁটের, বাকিটা বেড়ার। দুটো পুকুর ছিল আমাদের। পড়তাম মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে, তখন খুব নামডাক ছিল সেটির। বাড়ির কাছেই হত একটা আশ্রমের দুর্গাপুজো। পুজোর সময়ে অনেকক্ষণ থাকতাম ওখানে। আমাদের মত ছোট কয়েকজনকে ওরা কিছু দায়িত্ব দিত। আমার ভার ছিল ফুল তুলে আনার। পাড়ার একটা বাড়িতে ছিল স্থলপদ্মের ঝাড়। পুজোর ক’দিন খুব ভোরে, কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগে ওখান থেকে একগোছা পদ্ম নিয়ে যেতাম আশ্রমের ঠাকুরকে দেওয়ার জন্য। ময়মনসিংহ শহরের পুজোগুলোর মধ্যে নাম ছিল দাশুর তৈরি দুর্গাঠাকুর। গোপাল, পৃথ্বীশের মত কয় বন্ধু মিলে পুজোর দিনগুলো প্রতি সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে যেতাম। আলোর জাঁকজমক ছিল না। হ্যাজাকের ওই আলোই মনে হত স্বপ্নপুরী। বাবা বকতেন ঠান্ডা লাগতে পারে বলে। সতর্কতার জন্য গান্ধীটুপি, গায়ে চাদর জড়িয়ে বার হতাম। দুর্গাবাড়ির পুজো এখনও হয়। কাছেই ছিল ব্রহ্মপুত্র। দশমীর সন্ধ্যায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে বিসর্জন হত প্রায় একসঙ্গে। সেটাও দেখতাম বন্ধুদের সঙ্গে।

“আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল প্রায় ২২ মাইল দূরে। ট্রেনে ঢাকার লাইনে গফরগঞ্জ স্টেশনে নেমে যেতে হত। মাঝে মাঝে সপ্তাহ দুয়ের জন্য পুজোর ছুটিতে সবাই মিলে যেতাম সেখানে। ওই পরিবারে প্রায় সমবয়স্ক সন্তোষ, বেলা— ওদের সঙ্গে খেলা করতাম। কাছেই একটা বাড়িতে পুজোয় মোষ বলি হত। ওখানে যেতাম বলি দেখতে। এখনও যেন চোখে ভাসে গফরগঞ্জের লাহিড়ি বাড়ির আরতি।

“এক কাকা কাজ করতেন ইছাপুর রাইফেলসে। দেশান্তরী হয়ে ’৪৭-এ তাঁর খড়দহের ফ্ল্যাটে এসে উঠলাম। বাবার কর্মস্থল ছিল আলিপুরে। খড়দহ থেকে আলিপুর অনেকটা দূর। ১৯৪৮-এর শেষদিকে আমরা বেহালায় বাড়ি ভাড়া করলাম। এর পর ১৯৫০-এ যাদবপুরের বিজয়গড়ে। ’৫৭-তে আবার বাসাবদল। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে ফ্ল্যাট কিনে চলে এলাম। এতদিন বাদেও কিন্তু সেই ভিটের টান রয়ে গেছে। সেই যে দেশ ভাগের সময় ময়মনসিংহ ছেড়েছিলাম, প্রায় ২৩-২৪ বছর বাদে ২০০১ সালে আমরা দেখতে গেলাম। চেনা এলাকা, চেনা রাস্তা, চেনা বাড়িঘর। যদিও আমাদের অজান্তে এক পরিবার আমাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিল। তাঁরা প্রথমে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেননি। অনেক অনুরোধের পর পরে অনুমতি দেন। দেখলাম পারিবারিক আঁতুরঘরটি নেই। আর সব কিছু ঠিক আছে। তার পরেও ১০-১২ বার গিয়েছি ময়মনসিংহে।

“আজ ‘কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কেন, কোন পরিস্থিতিতে এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হলেন পূর্ববঙ্গের একটা বড় সংখ্যক হিন্দু? প্রত্যেকের হয়ত একটা করে স্মৃতিকথা আছে। সেটার মালা গেঁথে হতে পারে না একটা ‘ইস্টবেঙ্গল ফাইলস’? হোক না! না, কোনও বিষোদ্গার নয়, রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে নিছক স্মৃতিচারণ। আমাদের সময়ে ময়মনসিংহ শহরে গোটা পঁচিশ বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। এখন পাঁচটাও হয় কিনা সন্দেহ।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.