‘ই সালা কাপ নামদু’ স্লোগান অবশেষে সার্থক! ১৭ বছর পর বিরাটরাজার হাতে ‘সাবালক’ হয়ে উঠল আঠারোর আইপিএল

গত ১৭ বছর ধরে বার বার এই রিপোর্ট লেখা হয়েছে। কিন্তু প্রতি বার তা বাজে কাগজের বাক্সে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়েছে। অবশেষে অষ্টাদশ বর্ষে সেই রিপোর্ট রাতের উচ্ছ্বাস দেখল। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হলেন বিরাট কোহলি।

খেলা শেষ হতে তখনও চার বল বাকি। বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে চোখ ঢেকে ফেললেন কোহলি। চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। খেলা শেষ না হলেও তত ক্ষণে বেঙ্গালুরুর জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। তাই নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি কোহলি। শেষ বল হতেই মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। মাথা ঠেকালেন মাটিতে। ডাগআউট থেকে ছুটে এসে তাঁকে তখন ঘিরে ধরেছেন দুই সতীর্থ। কিছু ক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালেন কোহলি। বাকিরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। তত ক্ষণে গ্যালারিতে নেমেছে টিফো। সেখানে কোহলির মাথায় দেখা গেল মুকুট। পাশে লেখা, ‘এভরি সিঙ্গল ওয়ান অফ আস লাভস বিরাট কোহলি।’ লাল বলের ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া কোহলির জন্য তাতে ছিল শুভেচ্ছাবার্তাও।

খেলা শেষে মাঠে নামলেন কোহলির প্রিয় বন্ধু এবি ডিভিলিয়ার্স। তাঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কোহলি। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও এই দলকে ডিভিলিয়ার্স কতটা ভালবাসেন তা বোঝা যাচ্ছিল। কোহলি পরে জানালেন, তাঁদের উৎসবের মঞ্চে থাকবেন এবি। মাঠে নামলেন কোহলির আর এক বন্ধু ক্রিস গেইলও। তিনিও বেঙ্গালুরুর জার্সি পরেছিলেন। তাঁকেও দেখা গেল বেঙ্গালুরুর উৎসবে।

সতীর্থ, কোচ, বন্ধুরা পাশে থাকলেও তখনও কোহলির চোখ এক জনকে খুঁজছিল। বার বার গ্যালারির দিকে তাকাচ্ছিলেন তিনি। অবশেষে তাঁকে দেখতে পেলেন কোহলি। তিনি অনুষ্কা শর্মা। তাঁর সব লড়াইয়ের সাক্ষী। দু’বছর আগে এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে এই মাঠেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী অনুষ্কাকে জড়়িয়ে ধরেছিলেন কোহলি। এ বারও তাই করলেন। তবে সেই কান্না ছিল দুঃখের। স্বপ্নভঙ্গের। এই কান্না আনন্দের। স্বপ্নপূরণের।

তিন বছর আগে শুরু হয়েছে মহিলাদের আইপিএল। প্রথম বছর খুব খারাপ খেলছিল স্মৃতি মন্ধানার বেঙ্গালুরু। মরসুমের মাঝে তাঁদের উৎসাহ দিতে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর কোহলি। তিন বার ফাইনালে উঠেও হেরে যাওয়া কোহলি মন্ধানাদের বলেছিলেন, “আইপিএল কোনও দিন জিততে না পারলেও মৃত্যুর সময় কোনও আক্ষেপ থাকবে না। মনে হবে না, ইস্! আইপিএলটা জিততে পারলাম না!” কোহলি বেঙ্গালুরুর মহিলা ক্রিকেটারদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, জীবন শুধু আইপিএলেই সীমাবদ্ধ নেই। তার বাইরেও ক্রিকেট আছে, পরিবার আছে।

কিন্তু সে সব হল, যাকে বলে সান্ত্বনাবাক্য। কারণ, আইপিএল ট্রফি না-জিততে জিততে হতাশ কোহলি বেঙ্গালুরুর অধিনায়কত্বও ছেড়ে দিয়েছিলেন ২০২১ সালে! নিজের উপরেই বিশ্বাস ছিল না তাঁর। নেতৃত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিচ্ছি। নিজের উপরেই আর বিশ্বাস নেই। ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আর এই চাপ নিতে পারছি না। এ বার নতুন অধিনায়ক আসবে। নতুন স্ফূর্তি আসবে।” রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে কোহলির সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন এবি ডিভিলিয়ার্স। বহু বছরের সতীর্থ তাঁরা। এবি অবশ্য আর আইপিএল খেলেন না। ক্রিকেটমাঠের জুটি ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব ভাঙেনি। মঙ্গলবারের ফাইনালের আগে ডিভিলিয়ার্স বলেছিলেন, “আমি বিরাটকে অনেক বার বলেছি ওর আবেগ মাঠের বাইরে রেখে নামতে। তা হলে চাপটা কমে। কিন্তু বিরাট সে পরামর্শ শোনেনি। পরে বুঝেছি, ওই আবেগটাই ওর আসল শক্তি। ওটা না থাকলে ও খেলতেই পারবে না। ওর মনে যা, মুখেও তাই।” টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে মাঠেই টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। কিছুদিন আগে টেস্ট ম্যাচ থেকেও অবসরে গেলেন। অর্থাৎ, বিদায়ের দিগন্ত দেখতে পাচ্ছেন তিনি। ক্রিকেটারজীবন প্রলম্বিত করার জন্য ফিটনেসে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে শুরু করেছিলেন। একদিনের আন্তর্জাতিকে এখনও তিনি দেশের জন্য আছেন। কিন্তু কোহলি বিলক্ষণ জানেন, প্রদীপের তেল শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু নিজের উপর অতিরিক্ত ‘চাপ’ নিতে চাননি। ডিভিলিয়ার্সকেও পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ‘ই সালা কাপ নামদু’ (বাংলা তর্জমায় ‘এ বছর কাপ আমাদের’। বেঙ্গালুরুর সমর্থক ও ক্রিকেটারেরা প্রতি বছর এই স্লোগানই দিয়ে আসছেন) যেন ভুলেও না বলেন। কথা রাখতে পারেননি ডিভিলিয়ার্স। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় এক বার বলে ফেলেন। পরে কোহলির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন।

আইপিএলের ইতিহাসে কোহলিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি ১৮ বছর ধরে একটা দলেই খেলছেন। চেন্নাই টুর্নামেন্ট থেকে দু’বছর নির্বাসিত হওয়ায় মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে অন্য দলে খেলতে হয়েছে। রোহিত শর্মা দলবদল করেছেন। কিন্তু কোহলি বেঙ্গালুরু ছাড়েননি। পর্যাক্রমে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু তাঁর ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হয়ে গিয়েছে। শুরুতে দলের তরুণ প্রতিভা ছিলেন। নিজেই বলেছেন, প্রথম বছরে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল তাঁর। ব্যাট করতে নেমে প্রথম রানটা করা পর্যন্ত অসম্ভব নার্ভাস ছিলেন। উল্টোদিকে ছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স। তাদের প্রধান বোলার ইশান্ত শর্মা। যিনি কোহলির দিল্লি টিমের সতীর্থ। বিরাটের প্রথম কাজ ছিল ইশান্তকে উইকেট না-দেওয়া।

সেই কোহলি দ্রাবিড়-কুম্বলেদের ছায়া থেকে বেরিয়ে সিনিয়র হয়েছেন। শেষ কয়েক বছর তিনিই দলের ‘বড়দা’। অধিনায়ক না থেকেও পর্দার পিছনের নায়ক তিনিই। তাঁকে বাদ দিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত, কোনও পরিকল্পনা করে না বেঙ্গালুরু। রজত পাটীদারের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার আগেও কোহলির সবুজ-সঙ্কেত নেওয়া হয়েছিল। অনেকে বলেন, পাটীদার কোহলিরই ‘নির্বাচিত’। অধিনায়কত্বে তরুণ রক্ত আনতে চেয়েছিলেন বিরাটরাজ।

সেই তরুণ তুর্কিরাই কোহলিকে চ্যাম্পিয়ন করতে মাঠে উজাড় করে দিয়েছেন। যেমন ২০১১ সালে এক দিনের বিশ্বকাপটা সচিন তেন্ডুলকরকে জেতানোর পণ করেছিল গোটা ভারতীয় দল। আইপিএল ফাইনালের আগে পাটীদার বলে দিয়েছিলেন, “আমরা এ বার বিরাটভাইয়ের জন্য চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেষ্টা করব। এত বছর ধরে এই দলের জন্য বিরাটভাই লড়েছে। এটা ওর প্রাপ্য।” এই মনোভাব গত ১৭ বছরে দেখা যায়নি।

পঞ্জাবকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পরে গ্যালারিতে বসে থাকা স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার দিকে হাতের ইশারায় ‘এক’ দেখিয়েছিলেন কোহলি। পরে বলেছিলেন, “ওয়ান মোর টু গো।” আর একটা ম্যাচ। এ বারের আইপিএলে একটা একটা করে ম্যাচ ধরে এগিয়েছেন কোহলি। থেমেছেন শেষ স্টেশনে ফাইনাল জিতে। ৩৭ বছর বয়সেও বেঙ্গালুরুর সর্বাধিক রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে।

আইপিএলের ১৮তম বছরে ট্রফি উঠল ১৮ নম্বর জার্সিধারীর হাতে। এ বার আইপিএলের আগে সম্প্রচারকারী চ্যানেল একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে ‘১৮’-এর যোগ দেখছিলেন কোহলি। তারিখ ১৮। রেস্তোরাঁর টেবিল নম্বর ১৮। এমনকি, খাওয়ার শেষে লিফ্‌টে তিনি যাবেন কোন তলায়? ১৮! বিজ্ঞাপন বলেছিল, আইপিএলের অষ্টাদশ সংস্করণে কি চ্যাম্পিয়ন হবেন ১৮ নম্বর জার্সিধারী?

হল। বিরাটরাজের হাত ধরে সাবালক হল আঠারোর আইপিএল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.