প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জায়গায় নির্মাণ নিয়ে রাজ্যকে ভর্ৎসনা করল কলকাতা হাই কোর্ট। ৫০ বছরের পুরানো ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেহাল দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করে উচ্চ আদালত। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ‘‘বড় দিন এবং নতুন বছরে পার্ক স্ট্রিটে আলো জ্বালিয়ে খুবই গর্ব বোধ করেন। আর রাজ্যের মানুষ ভুগছেন। একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও ঠিক মতো চলছে না।’’ প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ৫০ বছর ধরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি শয্যা রয়েছে। তার পরেও স্বাস্থ্যসচিব রিপোর্ট দিয়ে বলছেন, উন্নতি করা হয়েছে। তাঁর মাথার উপরে অন্য কেউ রয়েছেন। হয়তো নিজেকে নিজের অফিসকে বাঁচাতে হবে। আর কত দিন এখান থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ধরে যেতে হবে রাজ্যের মানুষকে?
চিকিৎসা পেতে বেসরকারি হাসপাতালে কেন যেতে হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা কেন এত বছরেও বৃদ্ধি পায়নি? পরিষেবা উন্নত না করলে কেন মানুষ যাবেন না অন্য জায়গায় চিকিৎসা করাতে? হাসপাতালে পরিষেবা নেই। সরকারি হাসপাতালও নোংরা হয়ে রয়েছে। বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। মানুষকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। তাঁদের মরতে দিন! এখানে শুধু ভোট নিয়ে চিন্তা হয়। ভোটারদের নিয়ে নয়।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে সমস্যা সমাধান হয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ইচ্ছা ছাড়া আমলারা কাজ করতে পারেন না। তাঁদের কাজ আটকে যায়। আপনাদের আচরণ দুঃখজনক। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো একটু কি কাজ করতে পারেন না? এই সব পেলে কয়েক প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবে।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মথুরাপুর-২ নম্বর ব্লকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির জন্য জমি দেন জাকির হোসেন মোল্লার পিতামহ। অভিযোগ, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফাঁকা অংশে একটি পাম্প তৈরির কাজ চলছে। তাতে অনুমোদন দিয়েছে জনস্বাস্থ্য ইঞ্জিনিয়ারিং দফতর। ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন জাকির। তাঁর বক্তব্য, ১৯৬২ সালে তাঁর পিতামহ পুরন্দরপুর এলাকায় ছয় শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির জন্য ছ’বিঘা জমি দান করেন। পরে ১৯৭৬ সালে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নতির জন্য আরও কয়েক বিঘা জমি দান করেন তাঁর পিতা। তখন শয্যা সংখ্যা ছয় থেকে বেড়ে হয় ১০। এত দিন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভালই চলছিল। কোভিডের পর থেকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে নজর দেয়নি প্রশাসন। সেখানে দু’জন চিকিৎসক রয়েছেন। উন্নতির পরিবর্তে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জমিতে এখন নির্মাণ করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব আদালতে রিপোর্ট দিয়ে জানান, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থার উন্নতি করা হয়েছে। ওই রিপোর্ট দেখে হাই কোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘৫০ বছরের পুরনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি শয্যা রয়েছে। ১৯৭৬ সালেও যা ছিল ২০২৫ সালে এসেও তা-ই। এত বছরে একটিও শয্যা বৃদ্ধি করা হয়নি। স্বাস্থ্যসচিব বলছেন, সেখানে যথেষ্ট শয্যা রয়েছেন। এটি তাঁর অবস্থান। কিছু তো যুক্তিপূর্ণ কথা বলুন। এ বার ভাবুন, হাই কোর্টে ৩৪ জন বিচারপতি ছিলেন। এ বার কেউ যদি বলেন আর বিচারপতি দরকার নেই। সপ্তাহে ১০০টি মামলা দায়ের হয় আমরা সামলে নেব। এটা কি সম্ভব? আমরা চাইছি, বিচারপতি সংখ্যা ১০০-র বেশি করতে। ২০০ একর জমি পেলে সেখানে জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি হবে। আর ৪০ শতাংশ বিচারপতির আসন শূন্য পড়ে রয়েছে। আপনাদের অবস্থানে আমি খুবই হতাশ।’’
প্রধান বিচারপতির আরও মন্তব্য, জানি, ‘‘রাতারাতি কোনও ম্যাজিক দেখাতে পারবেন না। জানি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আশ্চর্য কিছু করতে পারবেন না। জানি, শহরকে নিউ ইয়র্কের মতো করে দিতে পারবেন না। কিন্তু কিছু তো পদক্ষেপ করুন।’’ রাজ্যের কৌঁসুলির উদ্দেশে তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘চন্দননগরে কোনও মাল্টি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল নেই। আপনারা বলেন, সেখানে হেরিটেজ টাউন, জগদ্ধাত্রী পুজো, হুগলি মহসিন কলেজ, সব ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে। কিন্তু দেখুন, কেউ অসুস্থ হলে মরতে হবে। কিছু করার থাকবে না। কলকাতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, আসল সুবিধা নেই। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের অবস্থা তো আরও খারাপ।’’ প্রধান বিচারপতি এই প্রসঙ্গে নিজের রাজ্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি তামিলনাড়ুর বাসিন্দা। প্রধান বিচারপতির কথায়, ‘‘আমার রাজ্যে গেলে দেখাব কী কী সুবিধা রয়েছে। ছুটি শেষে স্কুল খুললে স্কুলে মেডিক্যাল ক্যাম্প বসে। চিকিৎসকেরা কী কী করেন, দেখে আসুন। এখানে একটি হুইল চেয়ার পেতে গেলেও নির্দেশ দিতে হয়।’’
মথুরাপুরের ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে কোনও নির্দেশ দেবেন না বলেও জানান হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তাঁর কথায়, ‘‘আধিকারিকেরা জানেন, কী ভাবে কাজ করতে হয়। কোনও নির্দেশ দেব না। কমপক্ষে ৫০ শয্যার হাসপাতাল করুন যেখানে চুক্তিভিত্তিক কর্মী থাকবে না। কর্মীরা ভদ্রস্থ বেতন পাবেন।’’ আগামী ৪ মার্চ এই মামলার শুনানি।